এফএনএস : রাজধানীতে ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানটির নীতিমালা ও তদারকি অনুসারিত হয় সেটি হলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। রাজধানীতে ভবন নির্মানের বৈধতা ও অবৈধতার সার্টিফিকেট রাজউকের হাতেই। সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে রাজউক তবেই ভবন নির্মানের অনুমতি দিয়ে থাকে। কিন্তু স¤প্রতি রাজধানীতে ভবন নির্মাণ করতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পাশাপাশি সিটি করপোরেশনেরও অনুমোদন নিতে হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পলী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ভবন নির্মানের এই দ্বৈত পথ অতিক্রম করতে গেলে সামনে নানা জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাঁরা বলছেন, এমনিতেই ভবনের নকশা অনুমোদন করতে গিয়ে নগরবাসীর নানা ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। আবার সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিতে হলে ভোগান্তি আরও বাড়বে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাণিজ্য করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বরং এটা না করে ভবনের নকশা অনুমোদনের যাবতীয় কার্যক্রম সিটি করপোরেশনের হাতেই ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন বা রাজউককে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে একীভ‚ত করা যেতে পারে। রাজউক সিটি করপোরেশনের একটি শাখা হিসেবে কাজ করবে। যে শাখা কেবল ভবন নির্মাণ-সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করবে। এটি স্পষ্ট যে, রাজউক ৫০ বছর থেকে ঢাকায় ছোট-বড় সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে এবং তদারকির দায়িত্ব পালন করছে। তাদের এ ব্যাপারে রয়েছে প্রয়োজনীয় জনবল এবং দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা। অন্য দিকে সিটি করপোরেশনকে এ দায়িত্ব দেয়া হলে তারা পালন করবে কিভাবে? তাদের তো এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় জনবল নেই, কোনো কাঠামো নেই। বরং নতুন করে অনুমোদনের দায়িত্ব পেলে অবকাঠামো যারা বানাবেন তাদের অসন্তুষ্টির কারণ হবে সিটি করপোরেশন। এমনিতেই সিটি করপোরেশনের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণার শেষ নেই। আবার সিটি করপোরেশন যদি প্ল্যান পাশের দায়িত্ব পায় তা হলে সব কিছুই নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। সিটি করপোরেশন যে পারবে না, তা নয়; কিন্তু মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যাবে আরো কয়েকগুণ বলে মনে করছেন রিহ্যাব নেতৃবৃন্দ। তারা বলছেন, বাড়ির প্ল্যান পাস করতে গেলে রাজউকেই মানুষকে হয়রানি পোহাতে হয়। ঘুষ না দিলে সেখানে একট টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল যায় না। সিটি করপোরেশন দায়িত্ব পেলে তো এর চেয়ে উন্নতমানের সেবা মানুষ পাবে বলে আবাসন কোম্পানির ব্যবসায়ী মনে করছেন না। ভবন নির্মাণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশও (রিহ্যাব) একই ধারণা পোষণ করছে। সংগঠনটির মতে, এই দ্বৈত ব্যবস্থা একদিকে যেমন ভোগান্তি বাড়াবে, অন্যদিকে বাড়াবে দুর্নীতি। এতে এক শ্রেণির অসাধু চক্রের পকেট ভারি হবে। এ বিষয়ে রিহ্যাব সভাপতির ভাষ্য, ‘রাজউক ও তার জনবল এই কাজে একটি সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ৫০ বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ সক্ষমতা। সিটি করপোরেশন নবীনতম বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়। তাদের এই মুহূর্তে এ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় জনবল নেই, কোনো কাঠামো নেই। ফলে ভোগান্তি বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।’ সিটি করপোরেশনের সংযুক্তির ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে করপোরেশনের একাধিক সূত্র। সূত্র জানায়, বিষয়টি নিয়ে অনেকদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। কারণ, নকশা অনুমোদন দেওয়ার রেগুলেটরি বডি সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশন আইন-২০০৯-এর তৃতীয় তপশিলের ১৬ অনুচ্ছেদের ‘ঘ’ ধারা অনুযায়ী ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা সিটি করপোরেশনেরই। কিন্তু সিটি করপোরেশন এতদিন সেই আইনের ব্যবহার করেনি। এজন্য খুব শিগগির সিটি করপোরেশন এটা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করবে। এরপর থেকেই সিটি করপোরেশন ভবনের নকশা অনুমোদনের কাজ শুরু করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, রাজউক যখন ভবনের অনুমতি দেয়, তখন বাস্তবে কী তৈরি হচ্ছে, তা মনিটরিং করে না। ফলে দেখা যায়, ওই ভবনটি সিটি করপোরেশনের রাস্তার ভেতরে চলে এসেছে। তখন সিটি করপোরেশনের কাজ করতে অসুবিধা হয়। রাস্তা প্রশস্ত করতে গিয়ে দেখা যায় রাস্তার মধ্যে ভবন ঢুকে পড়েছে। তবে এটি ঠিক অন্যান্য দেশে নগরে ভবন নির্মান নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজউকের মতো স্বতন্ত্র সংস্থা দেখা যায় না। সেখানে সিটি গভর্নমেন্ট কর্তৃপক্ষ থাকে, যাদের অধীনে মেট্রোপলিটন এলাকার যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদিত হয়। বাংলাদেশেও ভবনের নকশা অনুমোদনের কার্যক্রম সিটি করপোরেশনের অধীনেই হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা হয়নি। এখন যদি রাজউকের পর সিটি করপোরেশন থেকে আবার অনুমতি নিতে হয়, তাহলে নগরবাসীর ভোগান্তি বাড়বেই। এ ক্ষেত্রে বরং সিটি করপোরেশনের একটি শাখা থাকা প্রয়োজন, যাদের কাজ হবে নকশা অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ। যে কাজটি বর্তমানে রাজউক করছে। কিন্তু রাজউকের আবার সিটি করপোরেশন থেকে নকশা পাস করাতে হলে জনগণের ভোগান্তির পাশাপাশি আর্থিক খরচও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তা হবে অপরিণামদর্শী হবে বলে অভিমত আবাসন ব্যবসায়িদের। তাঁদের মতে, ভিন্ন ভিন্ন তদারকি সংস্থার অনুমোদন শর্তের পারস্পরিক বৈপরীত্যের শিকার হবেন ভবন নির্মাণকারীরা। দুটো প্রশাসনকে একটি কাজের দায়িত্ব দিলে জনগণের ভোগান্তি শুধুই বাড়বে। ফাইল ছোড়াছুড়ির নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে। সমন্বয়হীনতা তৈরি হবে এবং নতুনভাবে প্ল্যান পাস করতে সময় বেশি লাগবে। রাজউক অবশ্য বলছে, মন্ত্রী যেভাবে কথাটি বলেছেন, বিষয়টি তেমন নয়। কেউ যেন নকশার বাইরে ভবন তুলতে না পারে, এজন্য সিটি করপোরেশন ও রাজউক যৌথভাবে মনিটর করবে। এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উলাহ নুরী বলেন, অনেক ভবনই নকশা মেনে তৈরি হয় না। তখন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সমস্যা হয়। মহাপরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য এখন থেকে সিটি করপোরেশন ও রাজউক একসঙ্গে মনিটরিংয়ের কাজ করবে। মন্ত্রী সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন।