বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪, ১১:৫৭ অপরাহ্ন

অবসর ভাতা প্রাপ্তির জটে \ জীবনপ্রদীপ নিভে যাচ্ছে অনেক শিক্ষক-কর্মচারীর

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় সোমবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

এফএনএস : শিক্ষা হলো জাতি গঠনের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি করতে না পারলে কোন জাঁতি অগ্রসর হতে পারে না। এজন্য বিশ্বের অধিকাংশ দেশে শিক্ষাখাতকে প্রভ‚ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে বহুযুগ থেকে শিক্ষাখাত চরমভাবে অবহেলিত হয়ে আসছে। এই খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীরা অতিবাহিত করে আসছেন মানবেতর জীবন। কেউ কোন চাকরি না পেলে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। এই অবস্থা থেকে দেশ অনেকটাই উত্তরণ করেছে শেখ হাসিনা সরকারের হাত ধরে। শেখ হাসিনা সরকার শিক্ষাখাতকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে এর যথেষ্ট উন্নয়ন সাধন করেছে। তবে উন্নয়নের পাশাপাশি কিছুকিছু ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়ে গেছে এখনো। শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বেসরকারি শিক্ষালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীরা। জানা যায়, শেষ জীবনে এসে টাকা না পেয়ে বেসরকারি শিক্ষালয়ের অনেক শিক্ষক অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। টাকার অভাবে অনেকের চিকিৎসা হচ্ছে না। আটকে আছে অনেকের কন্যার বিয়ে। অবসরে গিয়ে টাকার অপেক্ষায় থেকে কেউ কেউ মারা গেছেন এমন নজিরও আছে। সূত্র জানায়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসর ভাতা ও কল্যাণ সুবিধার অর্থের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এদের মধ্যে ৩২ হাজার ৬০০ জন অবসর বোর্ডে এবং ১৯ হাজার ৪৬০ জন কল্যাণ ট্রাস্টে আবেদন করেছেন। এটি স্পষ্ট যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ও বৈশাখীভাতা প্রদান করে সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তাছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সমস্যা ও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নয়নের কথা উপলব্ধি করে অতীতের ন্যায় ‘৮ম জাতীয় পে স্কেল’ প্রদান করে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে সমাদৃত হয়েছেন। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকরা অবসরে গেলে অবসর বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু দিন দিন অর্থ-দাবির আবেদনের পাহাড় জমছে সংস্থাটিতে। চাহিদার তুলনায় অর্থের প্রবাহ কম বা তহবিল ঘাটতিই এর প্রধান কারণ বলে জানা গেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টে জমাকৃত টাকার কোনো সঠিক হিসাব নেই। বিগত সময়ে কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা লোপাটের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষকদের জমাকৃত ট্রাস্টের টাকা ব্যক্তিগত ইচ্ছায় পছন্দের ব্যাংকে রেখে বিগত সময়ে কতিপয় সদস্য সচিব নিজেই লাভবান হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কল্যাণ ট্রাস্টের টাকার হিসাব চাওয়া হয়েছে। এ সংস্থার টাকা তছরুপের কথা কারও অজানা নেই। একজন ব্যক্তিকে বারবার একই পদে নিয়োগের ব্যাপারটা নিয়েও জনমনে অসন্তোষ বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের জমাকৃত টাকা নিয়ে একজন ব্যক্তির বিলাসিতা ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে শিক্ষক-কর্মচারীদের মাঝে। যেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক প্রবাদের মতো- ‘ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাঘডাসে।’ জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে সদস্য সচিব হিসাবে যারা দায়িত্ব পালন করে গেছেন তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছিল। এরমধ্যে বড় দুর্নীতি ছিল গোপন আঁতাতের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের টাকা সরিয়ে নেয়া। ফলে চাঁদার টাকায় শুধু আবেদনকারীদের বিদায় করা হতো। আয়ের তুলনায় দাবি বেশি থাকায় সৃষ্টি হয় মহাসংকট। এই মহাসংকটের ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত হন প্রধানমন্ত্রী। সংকট সমাধানের নিমিত্তে ২০১৬ সালে অবসর বোর্ডকে প্রধানমন্ত্রী ৬৫০ কোটি টাকার অনুদান দেন। এরমধ্যে ৫০০ কোটিই দেন স্থায়ী তহবিল হিসাবে। পাশাপাশি ২০১৭ সালে ১০০ কোটি ও ২০১৮ সালে ৫৩২ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেন প্রধানমন্ত্রী। থোক বরাদ্দের টাকায় শিক্ষকদের সুবিধা দেয়া হয়। যে কারণে আবেদনকারী অর্ধেকে নেমে আসে। আর স্থায়ী তহবিল এফডিআর করা হয়। বর্তমানে ৬১০ কোটি টাকার এফডিআর করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আরও ৩৫ কোটি টাকা স্থায়ী তহবিল হিসাবে দেয়া হয়। ভাতার দাবিদারের তালিকায় অজ¯্র নাম থাকলেও পাচ্ছেন স্বল্পহারে। দিন দিন তালিকার নাম কমার চেয়ে বরং জটের কারণে বাড়ছে। জানা যায়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে মোট অবসর ভাতার দাবিদার ছিলেন ২২ হাজার ৪৩৩ জন। গত ১৬ মাসে জট বেড়ে অপেক্ষমাণের তালিকায় সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৬০০। ২০১৬ সালে আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৬ হাজার। শিক্ষকদের দুঃখ-কষ্টের কথা জেনে পরপর তিন অর্থবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোর্ডকে ১৩১৭ কোটি টাকা দেন। এ কারণেই অল্পসময়ে ভুক্তভোগীর সংখ্যা অর্ধেক কমে গেছে। পরে বড় আকারের আর কোনো বিশেষ বরাদ্দ বা নিয়মিত বরাদ্দ না হওয়ায় ফের জট বেড়েছে। অবসর ভাতা ও কল্যাণ সুবিধার অর্থ পাওয়ার এই দীর্ঘসুত্রিতা, এই জট কবে অবসান হবে তা নিয়ে দুর্ভাবনায় অসংখ্য নিরুপায় শিক্ষক-কর্মচারী। এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার অবসান হওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবসর বোর্ডের পক্ষে থেকে অবশ্য দাবি করা হচ্ছে যে জট আগের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে। জটের ব্যাপারটি স্বীকার করে তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি উপেক্ষা করেই প্রতিদিনই কেউ না কেউ প্রাপ্য অর্থের তথ্য জানতে এই ভবনে আসছেন। কিন্তু তহবিল সংকটের কারণে চাহিদামতো সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না। তবে এটাও ঠিক যে, আগে জট আরও দীর্ঘ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষকের কথা ভেবে একাধিক দফায় বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছেন। তাতে অনেকের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। নইলে এ জট আরও দীর্ঘ হতো। অবসর বোর্ডের মতো কল্যাণ ট্রাস্টের কণ্ঠেও একই সুর বাজছে। তারাও দাবি করছে যে জট আগের তুলনায় বহুলাংশে কমে গেছে, যদিও এই সংস্থায় এখন ১৯ হাজার ৪৬০ শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন অনিষ্পন্ন আছে। কাজ দ্রুত নিষ্পন্ন না হওয়ার ব্যাপারে তাদের ভাষ্য, প্রাপ্য অর্থ পরিশোধের উৎস হচ্ছে দুটি। এগুলো হচ্ছে-এমপিও খাত থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের দেয়া চাঁদা এবং স্থায়ী আমানত থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ। কিন্তু এ আয়ের তুলনায় ব্যয়ের চাহিদা অনেক বেশি। যেহেতু সবাইকে প্রতিমাসে বিদায় করা যাচ্ছে না, তাই জট তৈরি হচ্ছে। জট দূর করতে হলে ঘাটতির অর্থ পূরণে নিয়মিত বাজেট থেকে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টে বরাদ্দ দিতে হবে। এ ছাড়া বিশেষ বরাদ্দও প্রয়োজন। উলে­খ্য, ২০০২ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা দেয়া শুরু হয়। আইন অনুযায়ী শিক্ষকরা প্রতিমাসে এমপিও বা বেতন থেকে চাঁদা দেবেন। শুরুতে এটা ৪ শতাংশ ছিল। পরে এটা ৬ শতাংশ করা হয়। পাশাপাশি প্রতিবছর এ খাতে সরকারি অনুদানও আসার কথা ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই এ অবসর সুবিধা বোর্ড চরম অবহেলিত। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ বোর্ডের এফডিআর ছিল মাত্র ৮৯ কোটি টাকা।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com