মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ পূর্বাহ্ন

ইউরোপের বৃহত্তম পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র রুশ দখলে

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় শনিবার, ৫ মার্চ, ২০২২

এফএনএস : ইউক্রেন তথা ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র জেপোরোজিয়ার দখল নিয়ে নিয়েছে রাশিয়া। শুক্রবার ভোরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর রুশ সৈন্যরা এটি দখলে নেয়। যুদ্ধের নবম দিনের এ হামলায় জেপোরোজিয়ার ছয়টি চুলি−র একটিতে আগুন ধরে যায়। তবে বিদ্যুতকেন্দ্রটির তেজস্ক্রিয় পদার্থ অক্ষত রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ জানিয়েছে। একই দিন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কাছের কয়েকটি এলাকায় হামলা জোরদার করে রুশ সৈন্যরা। বন্দরনগরী মারিওপোলের দখল নিতে ক্রমাগত আক্রমণ চালানো হচ্ছে। ইউক্রেন আক্রমণের কারণে রাশিয়ার ওপর একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে শুক্রবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ−াদিমির পুতিন। এক টেলিভিশন ভাষণে পুতিন বলেন, যারা ইউক্রেন অভিযানের বিরোধিতা করছে, তারা যেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা জারি না করে। এতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি আমাদের কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। ভাষণে তিনি আরও বলেন, সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে এমন কোন পদক্ষেপ প্রতিবেশী দেশগুলো নেবে না বলে তার সরকার মনে করে। বরং সম্পর্ক কিভাবে স্বাভাবিক করা যায় এবং কিভাবে সহযোগিতা বাড়ানো যায় সেটাই সবার চিন্তা করা উচিত। রুশ প্রেসিডেন্টের এ মন্তব্য এমন সময় এলো যখন রাশিয়ার ওপর কিভাবে চাপ বাড়ানো যায় তার পথ খুঁজে বের করার জন্য পশ্চিমা দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ব্রাসেলসে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে রুশ হামলার নিন্দা জানিয়েছে পশ্চিমারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এ ঘটনার নিন্দা জানান। হামলার ঘটনার জন্য ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোমিদির জেলেনস্কি মস্কোকে দায়ী করে বলেছেন, এটা পরমাণু সন্ত্রাস। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ বলেছে, এতে তাৎক্ষণিকভাবে তেজস্ক্রিয়তা বৃদ্ধি শনাক্ত করা যায়নি এবং আগুনে ‘আবশ্যকীয়’ সরঞ্জামাদির কোন ক্ষতি হয়নি। তবে এক্ষেত্রে রুশ বাহিনীর পরবর্তী পরিকল্পনা কী তা অস্পষ্ট রয়ে গেছে। খবর বিবিসি, আলজাজিরা ও ইন্টারফ্যাক্স অনলাইনের। জেলেনস্কি চেরনোবিল পরমাণু দুর্যোগের ‘পুনরাবৃত্তির’ চেষ্টা করায় মস্কোকে দায়ী করে বলেন, জেপোরোজিয়ার পরমাণু কেন্দ্রের এ সঙ্কটের ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ অন্যান্য নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। বাইডেন এ পরমাণু কেন্দ্রে জরুরী বিশেষজ্ঞদের যাওয়ার সুযোগ করে দিতে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কেন্দ্রেটির সরাসরি ভিডিও ফুটেজে রাতের আকাশে আগুনের ঝলকানি এবং ধোঁয়ার কুন্ডলি উঠতে দেখা গেছে। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদের দেশের ইতিহাসে এই প্রথম এমন ঘটল। মানব জাতির ইতিহাসেও পরমাণু কেন্দ্রে এমন হামলার ঘটনা প্রথম। ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ রাশিয়া এখন পরমাণু সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। জেলেনস্কির মতে, জেপোরোজিয়ায় সেখানে বিস্ফোরণ ঘটলে এতে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। ইউরোপ ধ্বংস হবে। এর কবল থেকে ইউরোপকে রক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেবল ইউরোপের দ্রুত পদক্ষেপ রাশিয়ার সৈন্যদের থামাতে পারে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, রাশিয়া ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি চায়। একে বেপরোয়া কর্মকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করে জেলেনস্কি বলেন, এ ধরনের আচরণ পুরো ইউরোপের নিরাপত্তাকে সরাসরি হুমকিতে ফেলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, এ পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে এলাকায় সামরিক তৎপরতা বন্ধ করার জন্য রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও একই কথা বলেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই ইউক্রেন দখলের ছক নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। বৃহস্পতিবার যুদ্ধের অষ্টম দিন পর্যন্ত রুশ সৈন্যরা দেশটির কয়েকটি বড় শহর ও বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। রাজধানী কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিতে হামলার তীব্রতা কয়েকগুণ বাড়ায় পুতিন বাহিনী। বৃহস্পতিবারও শহরটিতে দফায় দফায় হামলা হয়। নির্ধারিত ১৫ দিনের আগেই কিয়েভ দখলে এবার জলপথে হামলার প্রস্তুতি ক্রেমলিনের। এ লক্ষ্যে বুধবারই রাশিয়ার কয়েকটি রণতরী ইউক্রেনের দিকে যাত্রা করে। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, রসদে ঠাঁসা এসব রণতরী ক্রিমিয়া হয়ে ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে হামলা চালাবে। ওডেসা ইউক্রেন অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। পরের টার্গেট মারিউপল ও কিয়েভ। মার্কিন এই গোয়েন্দা তথ্য বিষয়ে ওডেসার মেয়র গেন্নাদি তুখানভ বৃহস্পতিবার বলেন, রুশ হামলার জবাব দিতে আমরাও প্রস্তুত। শহর রক্ষায় জনগণ বদ্ধপরিকর। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বুধবার ইউক্রেন থেকে অবিলম্বে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সাধারণ পরিষদে দুুদিনেরও বেশি সময় ধরে বিতর্ক শেষে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। পরিষদের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের ১৪১ দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ৩৫ দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। প্রস্তাবের বিপক্ষে দাঁড়ায় রাশিয়াসহ পাঁচ দেশ। মস্কোর ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনও ভোটদানে বিরত ছিল। ইরিত্রিয়া, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া ও বেলারুশ প্রস্তাবের বিপক্ষে দাঁড়ায়। এ সময় ইউক্রেন রাষ্ট্রদূত মস্কোর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তোলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, বিশ্ব রাশিয়ার মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইউক্রেনে মানবিক বিপর্যয়ের জন্য রাশিয়া দায়ী। প্রস্তাবে কঠোর ভাষায় ইউক্রেনে রুশ হামলার সমালোচনা এবং একইসঙ্গে পরমাণু শক্তিকে সতর্কাবস্থায় রাখার পুতিনের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানানো হয়। জাতিসংঘ সনদের আর্টিকেল ৫১ অনুযায়ী মস্কো আত্মরক্ষার কথা বলে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব মস্কোর এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, রাশিয়া জাতিসংঘ সনদের আর্টিকেল ২ লঙ্ঘন করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, সাধারণ পরিষদের এ প্রস্তাব কঠোর ও স্পষ্ট। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, কিছু বিদেশী নেতা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে বিশ্বাস করেন তিনি। তবে মস্কো একেবারে ‘শেষ’ পর্যন্ত ইউক্রেনে সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখবে। কারণ ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার অধিকার আছে। বৃহস্পতিবার মস্কোতে এক সংবাদ সম্মেলনে এই মন্তব্য করেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ইউক্রেনে হামলার ফলে রাশিয়ার ওপর কয়েকদফা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমারা। এ বিষয়ে মস্কো সাফ বলে দিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কখনই রাশিয়াকে টলানো যাবে না। ক্রেমলিন বলেছে, যেহেতু দুই দেশের মধ্যে এখন মুখোমুখি আলোচনা শুরু হয়েছে তাই উভয় দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে আপাতত বৈঠকের সম্ভাবনা নেই। ইউক্রেনে সাধারণ জনগণকে লক্ষ্য করে গুচ্ছবোমা ও ভ্যাকুয়াম বোমা নিক্ষেপের অভিযোগকে ডাহা মিথ্যা বলে খারিজ করেছে রাশিয়া। রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পশ্চিমারা রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংক ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাদের সম্পদ জব্দ করেছে। ইউক্রেন উপকূলে জাহাজ ডুবি : ইউক্রেন উপকূলে বিস্ফোরণের পর একটি কার্গো জাহাজ ডুবে গেছে। এটির এস্তোনিয়ার মালিকরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। মালিকরা জানিয়েছেন, প্রথমে দুই ক্রু সদস্য সাগরে লাইফ-জ্যাকেট ধরে ছিল। অন্য চারজন প্রাথমিকভাবে নিখোঁজ ছিল। পরে ছয়জনকেই ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ উদ্ধার করেছে। জানা গেছে, পানামার পতাকাবাহী জাহাজটির মালিক এস্তোনিয়াভিত্তিক কোম্পানি ভিস্তা শিপিং এজেন্সি। বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া ন্যাটোর সদস্য ও রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। কিছু দিন আগে ওডেসার কাছে চোরনোমর্স্কের দক্ষিণ বন্দর ছেড়ে যাওয়ার পর জাহাজটি ইউক্রেনের উপকূলে নোঙ্গর করা হয়েছিল। কিন্তু কি কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে- তা এখনও স্পষ্ট নয়। এর আগে ইউক্রেনে বাংলাদেশী জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে রকেট হামলায় নাবিক হাদিসুর রহমান আরিফের (২৯) মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছে ঢাকায় অবস্থিত রুশ দূতাবাস। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ সমবেদনা জানানো হয়। যুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশী জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে রুশ বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল বলে ইউক্রেনের গণমাধ্যমে খবর এলেও রাশিয়া বিষয়টি স্বীকার কিংবা অস্বীকার না করেই বলেছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে এ ঘটনার পর ওই জাহাজে থাকা বাংলাদেশীদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। মধ্যস্থতার প্রস্তাব সৌদি যুবরাজের : বৃহস্পতিবার রাতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ−াদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে আলোচনার সময় তিনি ওই প্রস্তাব দেন বলে সৌদি সংবাদমাধ্যমের খবর। যুদ্ধ থামাতে রাশিয়া-ইউক্রেন আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হওয়ার প্রস্তাব দিলেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমন। বৃহস্পতিবার রাতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ−াদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে আলোচনার সময় তিনি ওই প্রস্তাব দেন বলে সৌদি সংবাদমাধ্যমের খবর। তেল সরবরাহকারী রাষ্ট্রগোষ্ঠী ‘ওপেক’-এর অন্যতম সদস্য সৌদি আরব। রাশিয়া ওই গোষ্ঠীর পর্যবেক্ষক সদস্য। দুই দেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগও দীর্ঘ দিনের। সালমান ফোনে পুতিনকে জানিয়েছেন, মস্কোর স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখেই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পথ খোঁজার প্রয়াসে শামিল হতে চান তিনি।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com