কয়রা (খুলনা) প্রতিনিধি ॥ দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল ১৫ বছর।আজ ২৫ মে আইলা দিবস ২০০৯ সালের এই দিনে আইলার তান্ডবে সমগ্র কয়রা উপজেলা লবণ পানিতে ভেসে ক্ষতিগ্রস্থ হয় হাজার কোটি টাকার সম্পদ। কয়রার মানুষ আজও সেই দুঃস্বহ স্মৃতি বহন করে চলেছে। প্রায় দেড়যুগ আগে ঘটে যাওয়া সেই দূর্বিসহ জীবনের কথা মনে পড়লে অনেকেই শিহরে উঠে এবং আজ কয়রাবাসী যে দিনটির কথা মনে করছে। আরও একটি রেমেল নামে ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আইলায় ক্ষত ও ক্ষতির চিহ্নগুলো সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রার উপকূলবাসী আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন। আশ্রয়হীন জনপদে এখনো চলছে অন্ন, বস্ত্র,বাসস্থান ও খাবার পানির তীব্র হাহাকার। দীর্ঘ ১৫ বছর পরও ভয়াল সেই ঘূর্ণিঝড়ের কথা আজও ভোলেননি অবহেলিত কয়রার মানুষ। রয়েছে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে আইলার সেই স্মৃতি, যা দেখলেই মনে করিয়ে দেয় দুর্বিষহ দিনগুলির কথা। শনিবার (২৫ মে ২০২৪) কয়রায় অনেক গ্রামে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালিত হবে আইলা দিবস। নতুন প্রজন্মকে সে দিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি অর্থাৎ কষ্টের দিনগুলির কথা জানাতে এমন আয়োজন করা হয় কয়রায়। অথচ প্রায় দেড় যুগের বেশি সময় পার হলেও আইলার অনেক বড় বড় ক্ষত রয়ে গেছে কয়রায়। কিন্তু সে বিষয়ে সরকারি পদক্ষেপ না নেওয়ায় আরও বেশি মনে করিয়ে দেয় আইলার কষ্টের দিনগুলির কথা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়রার পবনার বেড়িবাঁধ ভাঙার কারণে দক্ষিণ মঠবাড়ী গ্রামকে দু’ভাগ করে সৈয়দখালী নামক একটি শাখা নদী তৈরি হয়েছিল। যেখানে আজও স্কুল কলেজ, মাদরাসার শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় হাজারো মানুষকে প্রতিদিন ভেলায় ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে দেখা যায়। যার একপারে প্রতাপস্বরনী হাইস্কুল, উত্তরচক কামিল মাদ্রাসা, মহিলা মাদ্রাসা, প্রাইমারি স্কুল ও কমিউনিটি ক্লিনিক এবং অপর পারে গ্রামের অর্ধেক অংশ। ঐ গ্রামের বাসিন্দা সুফিয়া বেগম প্রতিবেদক কে জানান, এই খালে বাঁধ না হওয়ায় আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ছে। কারন হিসেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এই দেড় যুগ শিশুদের ১ম শ্রেনি ও ২য় শ্রেনিতে পড়ার জন্য তাদেরকে স্কুলে পাঠাতে পারি না।আগে স্কুলে নৌকা পার হয়ে যেত কিন্তু এখন ভেলায় পার হয়ে যেতে হয়।শিশুরা ভয়ে ভেলায় উঠতে চায় না। এমনকি এমন কোন সপ্তাহ নেই যে দু’ পাঁচ জন শিশুরা ভেলা উল্টে যায় না। আর ভেলা উল্টে গেলে শিশুরা পানিতে পড়ে যায় এবং বই খাতা সব ভিজে যায়। তারা তো আর সাঁতার জানে না। এলাকাবাসী এবং ভেলায় বড় ছেলে মেয়ে কেউ থাকলে তারা পানি থেকে শিশুকে উদ্ধার করতে পারলেও তার কিন্তু ভয় কাটে না এমনকি বাড়ীতে আসার পর জ্বর এসে যায় আর এই জ্বর সেরে উঠতে অনেক দিন সময় লাগে। আর যে শিশু পড়ে যায় সে আর স্কুলে যেতে চায় না। আমরা তো গরীব মানুষ প্রতিদিন অন্যের বাড়ীতে, জমিতে, ঘেরে ও রাস্তায় কাজ করে খেতে হয় এজন্য শিশুদের স্কুলে নিয়ে বসে থাকতে পারি না। অন্যদিকে রহিম বলেন, এই ভেলা পার হয়ে হাইস্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের ছাত্ররা যায়। প্রায় গাদাগাদি করে ছেলেমেয়েরা ভেলায় উঠায় ভেলা উল্টে পানিতে পড়ে বই, খাতা ও গাইডবই সব ভিজে নষ্ট হওয়ায় আর কেনা সম্ভব হয় না। তখন তারা আর স্কুলে আর যেতে চায় না। ২য় শ্রেনির ছাত্রী সুমাইয়া বলে, আমরা স্কুলে যেতে ভেলায় উঠতি গেলে সরাত খাই পুড়ি যাই।আর পুড়ি গিলি পানিতে ডুবে মারা যাবানে তাই ভয় করে স্কুলে যেতে। অনুরূপ আইলার ক্ষতচিহ্ন আজও দৃশ্যমান বিভিন্ন রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ একাধিক বাড়ি-ঘরে। এছাড়া উপজেলার ৪ ও ৫ নং কয়রা এবং হরিহরপুর, পদ্মপুকুর, গাতীরঘেরি, হাজত খালী গ্রামের অনেক পরিবার আজও বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছেন। এদিকে আইলা পরবর্তী দীর্ঘ ১৫ বছর হরিহরপুর গ্রামের কপোতাক্ষ নদীর বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছেন ৭২ বছরের বৃদ্ধ অন্ধ আনার মোল্যা ও তার স্ত্রী ফুলি বিবি। তারা বলেন, আইলায় আমাদের কয়েক কাঠা জমির ওপর থাকা বাড়ি-ঘর এখন ওই চোরামুখা গেটের খালের মধ্যে, সেখানে এখন ১০/১২ হাত পানি। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে অন্য এলাকায় বসবাস করে, আর আমরা বুড়োবুড়ি সেই থেকে বাঁধের ওপর খুপড়ির মধ্যে থাকি। তারা জানান, কপোতাক্ষ নদী চরে চিংড়ীপোনা ধরে কোন রকমে দুই জনের খাবার জোগান। তবে কেউ এখন আর খোঁজ নেয় না। একটা সরকারি ঘর পেলে সেখানে জীবনের বাকি দিনগুলি কাটিয়ে দেবেন। তবে শুধু আনার মোল্লা নয়, ৫ নং কয়রা বাঁধের ওপর বসবাস ৭৫ বছরের রহিম বক্সসহ করিমন বিবি, জহিরন ও ভদি বিবিদের। অথচ একদিন তাদেরও ঘরবাড়ি সবই ছিল। কিন্তু আইলার কারণে সবকিছু কয়রা নদী গ্রাস করায় তাদের ঘরে ফেরার সুযোগ নেই। কয়রা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম বাহারুল ইসলাম জানান, তিনি। শুধু আইলা নয় ফণি, আম্পান ও সর্বশেষ ইয়াসে কয়রা ইউনিয়নের মতো অন্য ইউনিয়নেও অনেক ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। নির্বাচিত হয়েই ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট সংস্কার করে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ শুরু করেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহ ও ভূমিহীন অসহায় পরিবারের তালিকা তৈরি করে দ্রুত ঘর নির্মাণসহ সব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহযোগিতার প্রস্তুতি নিয়েছি। এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমেলের কথা শুনে উপজেলাবাসী আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। তারা তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে কখন আবহাওয়া বিপর্যয় আসে। আবারও পানিতে ভাসতে হয় কিনা সেই ভয়াল আইলার মত। এছাড়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের মধ্যে এখন চারটির বেড়িবাঁধ বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালী এলাকায় এক কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় প্রায় ৬০০ মিটার বাঁধ ধসে সরু হয়ে গেছে। মহারাজপুর ইউনিয়নের কাশিয়াবাদ, মঠেরকোনা, মঠবাড়ি, দশহালিয়া এলাকায় প্রায় ২ কিলোমিটার ঝুঁকিতে রয়েছে। উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে গণেশ মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত এক কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার এবং মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল এলাকা, তেঁতুলতলারচর ও চৌকুনি এলাকায় প্রায় ৩ কিলোমিটারের মতো বাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেখা গেছে। উপজেলা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি মোঃ খায়রুল বলেন, এ পর্যন্ত যতগুলো দুর্যোগ এসেছে, এর বেশির ভাগই মে মাসে। এ জন্য মে মাস এলে আতঙ্কিত থাকে উপকূলের মানুষ। তিনি আরও বলেন কয়রায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এক অদৃশ্য শক্তির অধিকারী। যে জন্য বেঁড়িবাঁধ না ভাঙা পর্যন্ত তারা উপকূলে বেঁড়িবাঁদের দিকে তাকায়ও না। বছরের মে মাস এলেই পাউবো কর্তৃপক্ষ বাঁধ মেরামতের তোড়জোড় শুরু করে। কী কারণে তা কেউ বলতে পারে না। অথচ শীত মৌসুমে কাজ করার অনেক সুবিধা। তিনি অভিযোগ করেন, বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টির জন্য পাউবোর লোকজন অসময়ে এসে কাজ ধরেন। তবে পাউবো খুলনা-২ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, সময়ের কাজ অসময়ে এসে করা হয়, এটা ঠিক না। আমরা বুঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের তালিকা করে বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। সেটি অনুমোদনে সময় লাগে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) বিএম তারিক- উজ- জামান বলেন, আইলার বিধ্বস্ত হয়ে যে খাল হয়েছে ওখানে যাতায়াতের জন্য দ্রুত একটা ড্রাম ব্রীজ করা পরিকল্পনা আছে। আসচছে ঘূর্ণিঝড় রেমেলের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এমনকি আগে থেকে সাইক্লোন শেল্টার গুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।