শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ০২:০৪ অপরাহ্ন

জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে উপকূলের কয়েক লক্ষ নারী \ বৃদ্ধি পাচ্ছে জরায়ু ক্যান্সার: বাড়ছে কেটে ফেলার সংখ্যাও

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩ জুন, ২০২২

স্টাফ রিপোর্টার \ জলবায়ু পরিবর্তনে চরম ঝুঁকিতে উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক লক্ষ নারী। মাত্রাতিরিক্ত নোনাপানির দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে জরায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব এলাকার নারীরা। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নারীর জরায়ু সংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা নোনাপানিপ্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি। গত কয়েক দশকে উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে যে উষ্ণায়ন, পরিবেশের বিপন্নতা তার প্রভাব প্রথম এসে পড়েছে নারীর ওপর। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যওায়া, নদী শুকিয়ে যাওয়া, দুই-একটি নলকূপে যেখানে মিষ্টি পানি ওঠে সেখানেও পানির জন্য হাহাকার। লবণাক্ত পানির কারণে এখানকার নারীরা এখন জরায়ু ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে ভুগছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর যে কয়েক লাখ নারী জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে, তার মধ্যে উলে­খযোগ্য অংশ উপকূলীয় অঞ্চলের নারী। সে জন্য অল্প বয়সেই এ এলাকার নারীরা জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে জরায়ু সংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সংখ্যা উলে­খযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলের নারীদের এই ঝুঁকিতে রেখে কিভাবে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও খুলনার কয়রায় নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে চুল ও ত্বকের ক্ষতি হচ্ছে। রং কালো হয়ে যায় ও দ্রুত বার্ধক্য চলে আসে। এছাড়া গর্ভপাত ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। সেখানকার নারী ও শিশুরা চিংড়িপোনা ধরার জন্য ভাটার সময় ভোরে ও দিনের বেলায় প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা তাদের লবণাক্ত পানিতে থাকতে হয়। এর ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ নারী অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন। জাতিসংঘ ২০২২ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ’। এই মূল প্রতিপাদ্যের আলোকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে- ‘টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ’। কিন্তু বাস্তবে উপকূলের নারীদের সমতা দুরের কথা, এখনো স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ‘সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততা প্রভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় ধুয়ে আবারো সেটি ব্যবহার করে এবং লবণাক্ত পানিতে গোসলসহ দৈনন্দিন কাজের কারণে তাদের জরায়ু সংক্রান্ত রোগের উপস্থিতি অনেক বেশি। উপকূলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই জরায়ু সংক্রান্ত রোগে নারীরা আক্রান্ত। ডাক্তাররা রোগীদের জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন। নারীদের পুরো জরায়ু কেটে ফেলার পর অনেকের স্বামী তাদের ফেলে অন্যত্র বিয়ে করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়েছে। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার গর্ভবতী নারীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, অতিরিক্তি লবণাক্ত পানি গ্রহণের ফলে নারীদের জরায়ু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্ম দেয়ার হার বেড়েছে। এছাড়া নারীরা দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ, গোসল, কৃষি কাজ, গবাদিপশু পালন, চিংড়ির পোনা ধরাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নারীরা লিউকোরিয়াসহ সাধারণ পানিবাহিত রোগ এবং চর্মরোগের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হয়। আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বলছেন, খাবার পানির সঙ্গে যে পরিমাণ লবণ নারীদের দেহে প্রবেশ করছে তার প্রভাবে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের গর্ভপাত বেশি হয়। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা যায়, সমুদ্র উপকূলের ২০ কিলোমিটার এলাকা এবং সমুদ্র তটরেখা থেকে সাত মিটার উচ্চতায় যারা বসবাস করে, তাদের গর্ভপাতের ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে যেসব নারী চিংড়ি রেণুপোনা সংগ্রহের কাজ করে তাদেরও প্রজনন স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা মোকাবিলা ও নারীদের জন্য জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকা সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ। তিনি বলেন, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর বিশেষত নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততা মোকাবিলায় অভিযোজন বা সহনশীলতার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছয় বছর মেয়াদি (জানুয়ারি-২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪) একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার ৫টি উপজেলার (কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, আশাশুনি ও শ্যামনগর) ৩৯টি ইউনিয়নের সাত লাখ মানুষ এ সুবিধা পাবে। এছাড়া উপকূলে নারী স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন, প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে নারী সংবেদনশীল সতর্কীকরণ ও দুর্যোগ প্রস্তুতি ব্যবস্থা গড়ে তোলার এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com