বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৪:০০ পূর্বাহ্ন

দীর্ঘ অপেক্ষার পড় আবারও শুরু ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ খচিত স্মার্ট কার্ড বিতরণ

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৪ মে, ২০২৪

ঢাকা ব্যুরো ॥ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের ভুল বোঝাবুঝির কারণে দুইবছরের বেশি সময়ের অবসান কাটিয়ে ফের শুরু হলো ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’খচিত স্মার্ট কার্ডের বিতরণ কার্যক্রম। গতকাল বৃহস্পতিবার আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন ভবনে ‘বীরমুক্তিযোদ্ধা’ খচিত স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু করছে নির্বাচন কমিশন(ইসি)। কমিশনের সচিব জাহাংগীর আলমের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। এছাড়াও নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা এ সময় উপস্থিত ছিলেন না। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচি ইশরাত চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। এ বিতরণ অনুষ্ঠানে ১০৪ জন বীরমুক্তিযোদ্ধাকে “বীর মুক্তিযোদ্ধা” খচিত স্মার্ট কার্ড প্রদান করা হয়। এদিন ১১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মঞ্চে ডেকে এই কার্ড প্রদান করে কমিশন। এ ছাড়াও ৮১ জনকে হাতে হাতে পৌছে দেওয়া হয়। ১২জনের স্মার্ট কার্ড প্রিন্ট না হওয়ায় তা আজ দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য অপরীসীম৷ পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রে হয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অথবা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে।পলাশীর যুদ্ধটাও যুদ্ধ। তবে সেটা ছিল লজ্জার যুদ্ধ। আমাদের স্বাধীনতা হরণ হয়েছিল। আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ গৌরবের, সম্মানের।যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা জতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস আপানা জানেন। ৫২, ৬৯, ৭০ এবং ৭১ ধাপে ধাপে চুড়ান্ত অর্জন হযেছিল। ৭ মার্চের একটি ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। তারপর ২৫ মার্চের কালোরাতে যে বর্বর হামলা চালানো হয়েছিল তাতে আমাদের যুবকরা যুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে ত্যাগ করতে হয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে অসামান্য একটা আখ্যান৷তিনি বলেন,আপনাদের কার্ডের সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখা থাকবে। এটা আমাদের আনন্দ দিচ্ছে। আপনারা থাকবেন না। কিন্তু আপনাদের সন্তানদের কাছে আপনার নাতি, নাতনিদের কাছে এটা আর্কাইভ হয়ে থাকবে। কখনোই হারাবেন না। এটা কিন্তু বীরত্বের একটি স্মারক৷ মুক্তিযোদ্ধাদের এই কার্ড না হারানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন,এই কার্ডকে হারাবেন না। এটা বীরত্বের একটি স্মারক। হয়তো আপনি থাকবেন না। আপনার কার্ডটা থেকে যাবে। নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন,আমার ভাষা আসছে না। আমি আসলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে কথা বলতে পারছি এটা গৌরবের। আপনারা জাতির সূর্য সন্তান। আপনারা বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের অবস্থান করে দিয়েছেন। নিয়ে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন,” একটু বিলম্ব হলে অনুষ্ঠানটা চলছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মত দ্বৈততা তবুও বিলম্ব হলেও হয়েছে তার জন্য আমি আনন্দিত পরিতৃপ্ত। আপনাদের একটাই লক্ষ্য দেশের স্বাধীনতা। আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আমার দুঃখ আমার বয়স তখন১০। আমি যেতে পারিনি। এই দুঃখ থাকবে আজীবন। আপ্নারা শতায়ু হন। মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে কমিশনের দূরুত্বের কথা উঠে আছে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের বক্তব্যেও। তিনি বলেন,এই বিষয় গত কমিশন থেকে শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। তারা আপত্তি দিয়ে এটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আপনারা যাদের সনদ দিয়েছে আমরা শুধু তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে যদি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় না দিতে পারি তাহকে এটা অগৌরবের থাকবে। অবশেষে তারা বুঝতে পারায় তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আনিছ সাহেবের মতন আমার বয়সও ১০। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি এই দুঃখ আজীবন থাকবে। আপনাদের যে সম্মান দিতে পেরেছি তা আপনাদের সম্মানের তুলনায় অনেক কম। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী বলেন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্য এই আয়োজন করা হয়েছে।যেভাবে ওনাদের সম্মান দেওয়ার কথা ছিল ৭৫ এর পর থেকে দীর্ঘ সময় ২১ বছর এই গৌরবটাকে মুছে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। চিকিৎসার ব্যয় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে করে থাকি। ২৪টি বিশেষায়িত হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসার সহায়তা করে থাকি। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন,২০০৭ সালে নবম নির্বাচনে নির্ভুল ভোটার তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করার কাজ শুরু করে। সাড়ে আটকোটি নাগরিককে কাগজে মুদ্রিত লেমিনেটেড কার্ড দেওয়া হয়। অপব্যবহার রোধে উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা হয়। তিনস্তরে ২৫টি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য দেওয়া হয়। বীরমুক্তিযোদ্ধা খচিত স্মার্ট কার্ড দেওয়ায় নতুন একটি মাত্রা যুক্ত হলো। যা বলছেন মুক্তিযোদ্ধারা : বীরমুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সচিব শফিক আলম মেহেদী বলেন,জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বীরমুক্তিযোদ্ধা খচিত স্মার্ট কার্ড দেওয়া নির্বাচন কমিশনের অনন্য উদ্যোগ। বীরমুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন আহম্মদ বলেন,১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিলাম। আমি গর্ব অনুভব করছি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মার্ট কার্ড দিয়েছে। এখানে আসার মতন যোগ্যতা আমার নাই। আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেই এখানে আসতে পেরেছি। বীরমুক্তিযোদ্ধা সায়মা খান বলেন,১৯৭১ সালে আমাদের পরিবারকে আর্মির হাত থেকে রক্ষা করেছেন। আমি আরো কৃতজ্ঞতা জানাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারকে। পরিবারের সবাই আমরা জীবন বাজি রেখে দেশ মুক্ত করতে গিয়েছিলাম।আমি গর্বিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জীবিত অবস্থায় দেখে গেলাম। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীরমুক্তিযোদ্ধা কাজী রিয়াজুল হক বলেন,বীরমুক্তিযোদ্ধাদের ধরে রাখার জন্য বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক কাজ করেছেন। এই সরকারের অধীনেই নির্বাচন কমিশন মুক্তিযোদ্ধাদের এই কার্ড দিয়েছে। তারা শুধু সম্মানটুকু পেতে চায়। এইটাই তাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) দাবি বেশি না। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জাবেদ আলী বলেন,তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানিত করার মাধ্যনে কমিশনও সম্মানিত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ এই স্মার্ট কার্ডের চিপের নিচ দিয়ে লেখা থাকবে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’। স্মার্ট কার্ডে তিন স্তরের ২৫টি নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথম স্তরের নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য খালি চোখে দেখা গেলেও দ্বিতীয় স্তরের বৈশিষ্ট্যগুলো দেখার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ যন্ত্র। অন্যদিকে ল্যাবরেটরিতে ফরেনসিক টেস্টের মাধ্যমে শেষ পর্যায়ের নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা যাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দটি ব্যবহারের বিধান করে ২০২০ সালে গেজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গেজেটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮-এর ধারা ২(১১)-এ মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬০ জন। ২০০৭ সালে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এনআইডি কার্যক্রম শুরু করে ইসি। এরপর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১১ সালে স্মার্ট কার্ড (আইডিইএ) প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সেই প্রকল্প শেষ হলে ২০২০ সালে আইডিইএ-২ প্রকল্প হাতে নেয়া হয় সরকারি তহবিল থেকে। বর্তমানে এর অধীনে দেশের সব নাগরিককে স্মার্ট কার্ড সরবরাহের কার্যক্রম চলছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নিজেদের মেয়াদপূর্তির এক দিন আগে নুরুল হুদা কমিশন রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে জমকালো আয়োজনে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মার্ট কার্ড দেয়। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারির ওই অনুষ্ঠানে ১০০ জনকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ খচিত বিশেষ স্মার্ট কার্ড দেয়ার অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। তবে সেবারও শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে কার্ড প্রদান করতে পারেনি কমিশন। এরপর দুই বছর তিনমাস পর গত ৭ মে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা’ খচিত নতুন স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র হস্তান্তরের মাধ্যমে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন ফের নতুন করে এ উদ্যোগ নেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com