শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১০:২৬ পূর্বাহ্ন

প্রবাসী আয়ে মেঘের ছায়া, বিপদে রেমিট্যান্সনির্ভর পরিবারগুলো

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

এফএনএস : করোনা মহামারীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে লেগেছে বিরাট ধাক্কা। ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কাটা এসেছে প্রবাসী খাত থেকে। এই সময়ে অসংখ্য প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। ফলে রেমিট্যান্স খাতে এক ধরণের মন্দাবস্থা দেখা দিয়েছে। দেশের সাথে সাথে বিপদে পড়েছে এসব ফিরে আসা প্রবাসীর পরিবারও। কেননা এসব পরিবার নির্ভর করতো রেমিট্যান্সের ওপর। দেখা যায় বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের। নিম্ন আয়ের এ পরিবারগুলো অন্য-বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ প্রাত্যহিক খরচ মেটাত এই রেমিট্যান্সের টাকায়। এ পরিবারগুলোকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা না হলে দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। স¤প্রতি ‘এশিয়ান ইকনোমিক ইন্টিগ্রেশন রিপোর্ট (এইআইআর) ২০২২’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা করা হয়। ২০২০ সালে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। সেই সময়ে রেমিট্যান্স গ্রহীতা পরিবারগুলোর ওপর ধারাবাহিক জরিপ পরিচালনা করে এডিবি। বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, করোনার ধাক্কা কাটাতে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর্মসংস্হানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন নগদ সহায়তা, মজুরি সহায়তা, কর্মসংস্হানবান্ধব কর্মসূচিও রয়েছে। কিন্তু সামাজিক সুরক্ষার এসব উদ্যোগ প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারগুলোতে পৌঁছানোর উপযোগী নয়। অথচ ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারগুলোতে আর্থিক সহায়তা খুবই প্রয়োজন। এর আগের ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক এক গবেষণায় বলেছিল, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে দারিদ্র্য বিমোচনে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ সা¤প্রতিক বছরগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে। এর পাশাপাশি পুষ্টি উন্নয়নে, শিক্ষার পেছনে ব্যয়ে এবং শিশু শ্রম কমাতে অবদান রেখেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহে পতন হলে এসব খাতে ব্যয় কমে যাবে। রেমিট্যান্স গ্রহীতা পরিবারগুলোকে বেশিরভাগ অর্থ খাদ্য ও অন্যান্য জীবিকার প্রয়োজনে ব্যয় করতে হবে। রেমিট্যান্সনির্ভর অনেক পরিবারের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। বিশ্বব্যাংকের সেই গবেষণার প্রতিফলন এখন দেখা যাচ্ছে। রেমিট্যান্সনির্ভর অনেক পরিবার এখন ঝুঁকির মুখে। এমতাবস্থায় অনেক বিশেষজ্ঞ এসব পরিবারকে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের পরামর্শ দিচ্ছেন। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স যে একটানা ধসের দিকে গেছে ব্যাপারটা অবশ্য এমনও নয়। করোনা মহামারী কালে রেমিট্য্যান্সে একধরণের উত্থান-পতন দেখা গেছে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, করোনার ধাক্কায় ২০২০ সালের মার্চে রেমিট্যান্স প্রবাহ সাড়ে ১২ শতাংশ কমে যায়। এপ্রিলে কমে প্রায় ২৪ শতাংশ। মে মাসে কমে প্রায় ১৪ শতাংশ। তবে ঐ বছর জুন মাস থেকে রেমিট্যান্স ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। রেমিট্যান্স প্রেরণে ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সাল শেষে সার্বিকভাবে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় রেমিট্যান্সে। রেমিট্যান্সের এই ধাক্কা পরিবারগুলোতে কী প্রভাব ফেলেছে সেটি বিশ্লেষণে তিন দফায় করা জরিপের তথ্য উলে­খ করা হয় প্রতিবেদনে। ২ হাজার ২১১ পরিবারে টেলিফোনে করা জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত পরিবারগুলো গড়ে রেমিট্যান্স পেয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৩৮০ টাকা করে। অথচ করোনার আগে প্রতি মাসে পরিবারগুলো গড়ে ১৮ হাজার ২৫৫ টাকা করে রেমিট্যান্স গ্রহণ করত। অর্থাৎ ঐ সময়ে গড়ে ৬৫ শতাংশ কম টাকা পেয়েছে পরিবারগুলো। জুলাই থেকে আগস্ট সময়কালে রেমিট্যান্স গ্রহণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে নতুন তথ্য। তাঁরা বলছেন, করোনা মহামারি শুরুর পর বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অবৈধ পথে আয় আসাও বন্ধ হয়। এ কারণে সব আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে আসতে শুরু করেছিল। এতে প্রবাসী আয়ে নতুন নতুন রেকর্ড হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। এখন যোগাযোগব্যবস্থা চালু হয়েছে। তাতে প্রবাসী আয়ও কমতে শুরু করেছে। করোনায় প্রবাসীরা যে ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তা এখন বোঝা যাবে। আবার জনশক্তি রপ্তানির চিত্রও সুবিধাজনক নয়। তাই সামনে আয় আসা আরও কমে যেতে পারে বলে তাঁদের ধারণা। জানা যায়, করোনা সংক্রমণের শুরুতে বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানির হার কমলেও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ বেশি ছিল। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো কমে যাওয়ায় বৈধ পথে বেশি অর্থ এসেছে। সরকার প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ওপর যে ২ শতাংশ প্রণোদনা দিয়েছে, তাতেও তারা দেশে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হয়েছেন। সে কারণে বিদেশে কর্মরত ওয়েজ আর্নাররা ছাড়াও সাধারণ ব্যক্তিও রেমিট্যান্স পাঠিয়ে প্রণোদনার সুযোগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে প্রবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের এই দুর্দিনে তাদের পাশে সরকারের দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সরকার অবশ্য তাদের পাশেই আছে। এর আগে সরকার তাদের প্রণোদনা দিয়েছে। তবে ফিরে আসা প্রবাসীদের পরিবারকে এখন নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রণোদনা দেওয়া উচিত। পাশাপাশি তাঁরা বলছেন, করোনাকালে বিদেশের শ্রমবাজারে যে ধস নেমেছে, তা মোকাবিলায় কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ৩টি বিষয় ধর্তব্যে নিয়ে এগোতে হবে- শ্রমশক্তি আমদানিকারক দেশগুলোর চাহিদামাফিক আমাদের কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণদান; দ্বিতীয়ত, শ্রমশক্তির নতুন বাজার ও খাত খুঁজে বের করা এবং বিদেশে গিয়ে আমাদের শ্রমিকরা যাতে অহেতুক হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে দূতাবাসগুলোর তদারকি জোরদার করা। তৃতীয়ত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ যেসব দেশে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির চাহিদা বেশি, সেসব দেশে ক‚টনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে দ্রুত আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলো দূর করা। করোনা মহামারী এখনো বিশ্ব থেকে বিদায় নেয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনা বিরাজ করছে বেশ জোরালোভাবেই। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে সৌদি আরব থেকে। এ দেশটিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আসে। এখানেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে এসব দেশে কর্মরত অনেক প্রবাসীই যেমন বাংলাদেশে চলে আসছেন। তেমনি দেশ থেকে নতুন করে ওইসব দেশে কোনো কর্মী যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে করোনাভাইরাসের সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে এ খাতে নেতিবাচক অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। সামনে আরও অনেক প্রবাসী ফিরে আসতে বাধ্য হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এই শঙ্কা খুব একটা জোরালো নয়। কেননা করোনা পরিস্থিতিকে সহজভাবে গ্রহণ করতে শুরু করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com