বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪৫ অপরাহ্ন

বংশীপুর ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণ মর্যাদায়

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৩

এস এম জাকির হোসেন শ্যামনগর থেকে \ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের বংশীপুর গ্রামে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শাহী মসজিদ। শ্যামনগর বাস টার্মিনাল থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিনে বংশীপুর বাসস্ট্যান্ডের উত্তর প্বার্শে অবস্থিত ঐতিহাসিক এ মসজিদটি। বংশীপুর গ্রামে অবস্থিত হওয়ায় বংশীপুর শাহী মসজিদ নামে পরিচিত এটি। অনেকেই বলেন টেঙ্গা মসজিদ। ঐতিহাসিক শাহী মসজিদটি ১৩৩ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা ও সোয়া ৩২ ফুট চওড়া। এমন লম্বাটে আয়তাকার মসজিদ আর কোথাও কেউ দেখেছে কি না কে জানে! এলাকায় গায়েবি মসজিদ নামেও এ মসজিদটি পরিচিত। কাগজপত্রে বংশীপুর শাহী মসজিদ নাম হলো প্রার্থনা ঘরটার। ঠিক কবে কে এই মসজিদ নির্মাণ করেছেন তার সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ বলা মুশকিল। তবে স্থাপত্য রীতিতে এটিকে মুঘল আমলের বলেই অবিভিত করা হচ্ছে। দাবির পারদ আর একটু চড়িয়ে মসজিদ কমিটি বলছে, এই মসজিদ মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে নির্মিত। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে মসজিদটাকে যাচাই করলে দেখা যায়, নির্মাণ রীতি মুঘল, তাই ষোল শতক থেকে আঠার শতক পর্যন্ত যে কোনো সময়ই এই মসজিদ নির্মাণ হওয়ার কথা। কিন্তু মসজিদটার অবস্থান মূলত ষোড়শ’ শতকের যশোরের রাজা, বাংলার বিখ্যাত জমিদার বা ভুঁইয়া প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ধুমঘাটের কাছেই, ঈশ্বরীপুরে। যেখানে সুলতান দাউদ খান কররানির সম্পদে মহারাজা বনে যাওয়া রাজকর্মচারী শীহরির (শ্রীধর) রাজ্য। যার পুত্র প্রতাপাদিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত যশোরেশ্বরী ও চন্ডা মন্দির, যিশুর গির্জা আর হাম্মামের অবস্থান এই মসজিদের খুব কাছেই। যেহেতু বিশ শতকের গোড়ার দিকেই মাটির নিচ থেকে মসজিদটি নতুন করে আবিষ্কৃত হয়। তাই নির্মাণের পর মসজিদটি বহু বছর পরিত্যক্ত ছিলো। বাংলাদেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার অনুকুলে দ্রুত বেড়ে ওঠা লতা-গুল্ম ঢেকে ফেলেছিলো মসজিদটাকে। তারওপর এ মসজিদের গাঁথুনিতে ব্যবহৃত ইটের সঙ্গে মিল রয়েছে অনতি দূরের যশোরেশ্বরী আর বারোদুয়ারি মন্দিরে ব্যবহৃত ইটের। তাহলে ধুমঘাটে রাজধানী স্থাপনের সময়ে ঈশ্বরীপুরসহ আশপাশের এলাকায় নির্মিত ইমারতগুলোরই একটি হওয়ার সুযোগ উজ্জ্বল হয় মসজিদটির। টেঙ্গা মসজিদের গম্বুজের নিচের কারুকাজ এমসজিদের আগের নামও ওই সময়কেই নির্দেশ করে। কার্যত রাজা প্রদাপাদিত্যের একজন বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন খাজা কামাল। মুসলিম সৈন্যদের জন্য তার উদ্যোগে এখানে প্রথমে একটি ছাউনি গড়ে প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়। এ ধরনের ছাউনিকে তখন টেঙ্গা বলা হতো। এই ফারসি শব্দটির বাংলা অর্থও ছাউনি। ছাইনির কারণেই টেঙ্গা মসজিদ নামে পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে মসজিদটির। কিন্তু পরিত্যক্ত হয়ে পড়ার পর টেঙ্গা নামটি হারিয়ে যায়। বর্তমানে বংশীপুর শাহী মসজিদ নামে পরিচিতি এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে তাই সম্রাট আকবর ও রাজা প্রতাপাদিত্য উভয়ের শাসনামল ধরেই হিসাব করা ভালো। দিল্লির মসনদে সম্রাট আকবর ছিলেন ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আর ১৫৭৪ সালে রাজবংশ প্রতিষ্ঠার মাত্র বছর দশেকের মাথায় ১৫৮৪ সালে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন প্রতাপাদিত্য। যেহেতু ১৫১১ খিস্ট্রাব্দে প্রতাপাদিত্যের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই শুরু হয় তাই শেষ কয়েক বছর ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণের মতো শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি প্রতাপাদিত্যের রাজ্যে থাকার কথা নয়। আর ১৫১১ সালে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে খাজা কামাল প্রতাপাদিত্যের নৌবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হয়ে ক্ষুদ্ধক্ষেত্রে সময় কাটাতে থাকেন। আবার ১৫৮৪ সালে সিংহাসনের আরোহনের পর সেনাবাহিনী গোছাতেই প্রতাপাদিত্যের কয়েক বছর লেগে যাওয়ার কথা, তাই ধরে নেওয়া যায়, ষোল শতকের শেষ দিকে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। পরবর্তীতে মুঘল বাহিনীর কাছে প্রতাপাদিত্যের শোচনীয় পরাজয়ের পর মসজিদটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু স্থানীয়দের আবিষ্কার করা এ মসজিদ তার ঐহিত্য হারাতে থাকে স্থানীয়দেরই অদূরদর্শিতায়। উদ্ধারের পর মসজিদটি তা সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ভারতীয় প্রতœতত্ত্ব বিভাগ। কিন্তু স্থানীয়রা নিজেদের মতো করে সংস্কার করতে দিয়ে মসজিদটির অনেক কিছুই নষ্ট করে ফেলে। মসজিদের নকশা ও ইটের কারুকাজ সিমেন্ট-বালির প্লাস্টারে ঢেকে দেয় তারা। পরে মোজাইক করে ঢেকে দেয় মসজিদের মেঝে। সংস্কারকদের আনাড়িপনায় গম্বুজের নিচ থেকে আটকোণাকার ঘাড়গুলো আজ বিলুপ্ত। খাঁজগুলো মুছে গেছে খিলানাকার দরোজা থেকে। উত্তর ও দক্ষিণের খিলান দরজা দু’টো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পাকা গাথুনিতে। শিলালিপি না থাকায় এই মসজিদের নির্মানকাল নিয়ে দুই ধরনের মতামত রয়েছে। একটি মত অনুসারে রাজা প্রতাপাদিত্য তার মুসলিম অনুসারীদের জন্য নির্মাণ করেন। অপর মতানুসারে মোঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ এটি নির্মাণ করেন। ৫টি গম্বুজ বিশিষ্ট ৪১মিটার দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ১০ মিটার প্রস্থের মসজিদটি কিছুটা মুঘল আমলের নিদর্শন বহন করে। ইট দিয়ে নির্মিত এই মসজিদটি একসময় ব্যবহার উপযোগী না থাকলেও বর্তমানে ব্যাপক সংস্কার করে মসজিদটিকে আধুনিকরণ করা হয়েছে। মসজিদের সম্পূর্ন মেঝে ও দেওয়াল টাইলস করা হয়েছে। মসজিদের প্রতিটি কক্ষের পশ্চিম দেওয়ালে অবতল মিহরাব। মাঝের মিহরাবটি অপরগুলোর তুলনায় একটু বড়। মসজিদটির উত্তর-পূর্ব দিকে হাল আমলে নির্মিত কয়েক তলা উঁচু মিনার। উদ্ধারের পর টেঙ্গা মসজিদ প্রাঙ্গণে কয়েকটি বৃহদাকার কবর পাওয়া যায়। এগুলোর একটি ১৪ হাত লম্বা। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে বার ওমরাহ বলা হয়ে থাকে। এগুলো প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে প্রেরিত ১২ মুঘল সেনাপতির সমাধি বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে মসজিদটির পূর্ব দিকে নব নির্মিত বারান্দার সঙ্গে ২টি দীর্ঘকায় কবর ঘিরে রাখা আছে। প্রাচীন কুয়াটা চাপা পড়েছে ওই বারান্দারই নিচে। মসজিদের মূল ভবনের ৫ টি কক্ষে ২ টি করে মোট ১০টি এসি লাগানো আছে। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজে বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মুসুল্লি এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসেন। জুম্মার নামাজের দিন মুসুল্লিদের মিলন মেলায় পরিনত হয় মসজিদ প্রাঙ্গন। এছাড়া বহু দুর-দুরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা একনজর দেখার জন্য এ মসজিদে ভীড় জমান।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com