আলমগীর হোসেন, বিষ্ণুপুর থেকেঃ কালিগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের মুকুন্দ মুধুসুদনপুর গ্রামে এক সময় গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া আর অতিথি আপ্যায়ন, প্রায় সব কাজেই মাটির তৈরি হাড়ি পাতিলের ব্যবহার ছিলো। স্বাস্থ্যকর আর সহজ লভ্য ছিলো বলে সব পরিবারেই ছিলো মাটির পাত্রের ব্যবহার। শীতে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য হাড়ি, বাহারি চিতই, পুলি ও ভাঁপা পিঠাসহ নানান জাতের পিঠার জন্য খোলা, দধির পাতিল, টালি, মাটির কলস,লক্ষীঘট, খোলা মুচি, নাদা, মুটকিথালা বাসন,হাড়ী পাতিল সহ বিভিন্ন মাটির সরঞ্জাম তৈরি করতো গ্রাম বাংলার কুমাররা। সেগুলো ভ্যান বা মাথায় করে বিক্রি করেই চলতো তাদের সংসার। খড়, কাঠি আর মাটির সাথেই তাদের জীবনপণ যুদ্ধ ছিলো। তাদের এই বাহারি মাটির তৈরি সরঞ্জাম তৈরি দেখতে ভিড় জমতো শত শত মানুষ। আর চুলোয় আগুন দেবার সময় আয়োজন করতো কুমাররা, মিষ্টি কিংবা ছিড়ার মোড়া বিলি করতো তারা। সময়ের পেক্ষাপটে হারিয়ে গেছে এসব চিত্র। এখন তারা কুমার পেশা ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন পেশায় ধাবিত হচ্ছে। এর ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের ঐতিহ্য আর গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি। মুকুন্দ মুধুসুদনপুর গ্রামে এখন মাত্র ৫/৭ টি পরিবার মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িত থাকতে দেখা যায়। শুক্রবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর গ্রামের কয়েকজন কুমারের সাথে কথা হয়, তারাপদ পাল নামে এক কুমার ও তার স্ত্রী রাধারানী পাল, তাদের দুর্বিসহ যন্ত্রণার কথা বলেন। এ পেশায় ঠিকমতো সংসার চলে না তাদের। খেয়ে না খেয়েই কাটে তাদের সংসার। এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যাবার পুঁজি নেই বলে পেশা পরিবর্তন করতে পারছেন না তারা। সুপদ পাল নামে এক কুমার বলেন, এক সময় মাটি পেতাম বিনামূল্যে, আর গত দু’বছর আগেও তা ছিলো মাত্র চারশ’ টাকায় প্রতি গাড়ি। আর এখন তা বারোশ থেকে পনেরো শ, টাকায় মাটি কিনতে হচ্ছে। কাঁচামালগুলো পোড়াতে কাঠ আর খড়ের দামও বেড়েছে কয়েকগুন। সব মিলিয়ে বাজারের সব কিছুর দাম বাড়লেও দাম বাড়েনি মাটির তৈরি সরঞ্জামের । একটি খোলা তৈরিতে প্রায় ১৫ টাকা খরচ হলেও বিক্রি হয় ২০/২২ টাকা। এ সময় হরিপদ পাল, সন্তোষ পাল ও জানান একই কথা। সরঞ্জামাদি তৈরিতে খরচের সাথে বাজার মূল্য নেই। এছাড়াও আগের মতো এখন আর মাটির পাত্রের চাহিদাও নেই। কারো প্রয়োজন হলে মাঝে মধ্যে নেন। বছরের অধিকাংশ সময়ই কাটে বসে থেকে। এ পেশায় থাকার কারণে আর কোনো কাজ করতে পারেন না তারা। এজন্য সংসার চালাতে কষ্ট হয়। এক সময় পালদের সবাই ছিল কুমার পেশার সাথে, এখন আর নেই। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাব, দাদার এই পেশা বাদ দিয়ে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা এদিকে অধিকাংশই কষ্ট করে হলেও বাবা-দাদার এ পেশা চালিয়ে যেতে বাধ্য। তারা আরো বলেন, সরকারি সহযোগিতা আর বাজারের চাহিদা থাকলে হয়তো হাজার বছরের ঐতিহ্য এ পেশাটি টিকে থাকতে পারবে। নতুবা কালের আবর্তনে হারিয়ে যাবে মৃৎ শিল্প।