ওয়াদুদ সাহেব সারের দোকানে বন্ধু-বান্ধব নিয় গল্প করছিলেন, তখন প্রায় সন্ধ্যা সমাগত, হঠাৎ দোকানে রিপনকে আসতে দেখে তিনি রীতিমত অবাক হলেন, ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে ওয়াদুদ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার রিপন, অসময়ে বাজারে এসেছো কেন? ‘আমায় দুটো বড় রসগোল্লা কিনে দাও আব্বু। ‘তোমার রসগোল্লা খেতে ইচ্ছে হয়েছে তো আমাকে আগে বলতে পারতে? আমি কিনে নিয়ে যেতমা। রিপন কথার উত্তর দিল না, ওয়াদুদ সাহেব ক্যাশ বাক্স থেকে একটি কুড়ি টাকার নোট বের করে ছেলের হাতে দিয়ে বললেন, মগফুরের হোটেল থেকে দুটো বড় মিষ্টি কিনে সোজা বাড়ি যাবে, একটা নিজে খাবে, আর একটা বোনডিকে দেবে বুঝলে? রিপন মাথা নেড়ে চলে গেল, মগফুরের হোটেলের মিষ্টি শুক্লার খুব পছন্দ, কেমন যেন আয়েশ করে ঠুকরে ঠুকরে খায় মিষ্টি। রিপন বোঝে শুক্লার চাহিদার কথা। ভাগের মিষ্টিটাও পর্যন্ত রিপন খেলো না। সন্ধ্যার সাথে সাথে বাড়ি এলো রিপন, শুক্লাকে দরজা খুলে বের করে আনা হলো, সে মিষ্টির প্যাকেট দেখে উল্লাসে বিভিন্ন রকম বোল ডাকতে লাগলো। শুক্লাকে রিপন পাখির কোঠর থেকে আঁতুর অবস্থায় উদ্ধার করেছিল। তখন ওর গায়ে পশম গজায়নি। লাল চামড়া দেখা যেতো, তারপর টিয়া পাখির ছানাটা বড় হলে তার নামকরণে নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিল, অবশেষে ছোট মামার সহায়তায় তার নাম রাখা শুক্লা। শুক্লা নামটি ছোট মামার খুব পছন্দ। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল, রিপন পড়তে বসলো না, শুক্লাকে বিভিন্ন রকম বোল শেখাতে লাগলো। আম্মা জোহরা এসে রিপনকে পন: পড়ার তাগিদ দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু লাভ হলো না, রিপন টিয়া পাখির পরিচর্যায় মেতে উঠলো, রাত গভীর হলে রিপন বিভিন্ন রকম ভংগীতে চেঁচাতে লাগলো, সে শুক্লাকে নিয়ে দিনের বেলায় যা করে, তাই করতে লাগলো, ওয়াদুদ সাহেব স্ত্রীকে বললেন- আগে টিয়া ছানাটাকে তাড়াও, নইলে দেখবে এক সময় বিপদের অন্ত থাকবে না। ‘বাপরে বাপ, ওরে তাড়ালে কি রক্ষে আছে? ‘না তাড়ালে ঠেলাটা বুঝবে শেষে, সারাদিন যদি সে টিয়ার পেছনের সময় কাটায় তাহলে বই পত্রের সঙ্গে সাক্ষাত ঘটবে কখন? তাই বলছিলাম কি রিপনের আম্মা, সময় থাকতে ওকে বিদেয় কর। জোহরা বেগম পক্ষে বিপক্ষে কিছুই বললো না। পরদিন সকালে দোকানে যাওয়ার আগে ওয়াদুদ সাহেব একবার ভাবলেন, খাঁচার মুখটা আগলা করে যাওয়া যাক শুক্লা উড়তে শিখেছে ফুড়, করে উড়ে গেলেই সব ঝামেলা চুকে যাবে। কিন্তু কি ভেবে তিনি তা করলেন না। এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। স্কুলের স্যারেরা সম্মিলিতভাবে রিপনের বিরুদ্ধে নালিশ করলেন ওয়াদুদ সাহেবের কাছে, স্কুল ফাঁকি দেওয়া, পড়া অমনোযোগ, বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আনা হলো রিপনের বিরুদ্ধে। ওয়াদুদ সাহেব এবার রীতিমত রেগে গেলেন, তিনি বুঝলেন, সব কিছুর মূল ঐ টিয়া পাখিটা। দুপুর গড়িয়ে গেলে তিনি থমথমে মেজাজে বাড়ি ফিরলেন। এসেই তিনি রিপনকে না পেয়ে আরো রেগে গেলেন। রিপন শুক্লার জন্য আধা খুঁজতে গেছে। ওকে সংবাদ দিয়ে বাড়ি আনা হলো। ওয়াদুদ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রিপন আজ ভয়ানক ভড়কে গেলো। রাতদিন স্কুল-পড়াশুনা বন্ধ দিয়ে টিয়া পাখির ছানা নিয়ে হৈ চৈ করে ঘুরে বেড়ানোর মজাটা আজ দেখাচ্ছি। খপ করে রিপনের হাত দুটো ধরলেন ওয়াদুদ সাহেব, তারপর দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিলেন ঘরের আড়ার সাথে রিপন শূণ্যে ঝুলতে লাগলো। বাড়ির সব সদস্যরা ছুটে এলো, রিপনকে উদ্ধার করতে। কিন্তু কেউ সাহস পেলো না। ওয়াদুদ সাহেব জোহরা বেগমকে এমন কথা বললেন, যাতে তিনি আর এক পাও নড়তে পারলেন না। শুধু বন্দী পাখির মত ছটফট করতে লাগলেন। রিপনের কান্না শুনে বৃদ্ধা দাদী এসে সে যাত্রায় ওকে উদ্ধার করলেন। যে কয়দিন গায়ে ব্যথা ছিল, সে কয়দিন আর রিপন শুক্লার কাছে গেল না। মনে হলো, রিপনের অভাবে শুক্লাও শুকিয়ে যাচ্ছে। শুক্লার মনের আনন্দ নষ্ট হলো। কেমন যে মনমরা হয়ে পড়ে থাকলো সে। এবার আর বইয়ে মন না দিলেই নয়। কদিন বাদেই পরীক্ষা। রিপনের মনটা হাহাক করে উঠলো এখন ওকে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করতে হচ্ছে, আর মগফুরের হোটেল থেকে মিষ্টি আনতে পারছে না রিপন। মাঠ থেকে ফড়িং মেরে ওকে আর খাওয়াতে পারছে না। জোহরা বেগম শুক্লাকে দায়সারা গোছের খেতে দেয়। তাতে মন ওঠেনা শুক্লার। নানা রকম শব্দ করে খুঁজে ফেরে রিপনকে। সবাই যখন ঘুমে অচেতন তখন এক পা দুপা করে রিপন এগিয়ে গেল শুক্লার খাঁচার কাছে। শুক্লা তখনো রিপনের জন্য জেগে আছে। রিপন শুক্লার গায়ে হাত বুলিয়ে ফিস ফিস করে বলতে লাগলো শুক্লা আমার পরীক্ষা চলছে, তোর দিকে খেয়াল নেওয়ার সময় পাচ্ছিনে। এবার যদি পরীক্ষা খারাপ হয় তাহলে আমার আব্বা আমাকে আর আস্ত রাখবে না। তোর জায়গাও আর এ বাড়িতে হবে না। সামনে আর কদিন তোর দিকে খেয়াল রাখতে পারবো না। আম্মু যা দেয় পেট ভরে খাস, নইলে তুই কিন্তু মারা যাবি। শুক্লাকে ছেড়ে আসতে রিপনের খুব কস্ট হলো। সকাল হলে বাংলা পরীক্ষা শুরু হবে। পরের দিন ইংরেজি। ইংরেজিটা মোটেও হাতে চায় না রিপনের। চিন্তা বেড়ে যায় প্রচুর। কি করবে সে, সাত সতেরো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রিপন। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখে শুক্লা তাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। তাকে আর নাগালের মধ্যে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় রিপনের, এসব কি আজে বাজে স্বপ্ন দেখছে সে। জোহরা বেগম বিজ্ঞের মত দুঃস্বপ্নের কথা মনে বললেন, এসব তোমার দুশ্চিন্তার ফল, সামনে তোমার পরীক্ষা তো, তাই পরীক্ষার চিন্তায় এসব হচ্ছে। পরদিন পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে রিপন শুক্লাকে বলে গেল, অনেক দিন তোকে মিষ্টি খাওয়াতে পারিনি শুক্ল, পরীক্ষা দিয়ে ফেরা পথে তোর জন্য মগফুরের হোটেল থেকে ইয়া বড় মিষ্টি আনবো। পরদিন পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে রিপন তার কথা রাখলো ঠিকই, কিন্তু হায়! বাড়ি এসে দেখলো শুক্লা নেই, খাচার দরজা খোলা। মাথায় হাত দিয় বসে পড়লো রিপন, কাল তার ইংরেজি পরীক্ষা। সেদিকে খেয়াল নেই। মিষ্টির প্যাকেট টা সেভাবেই পড়ে রইল। কারো কোন অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে প্রশ্ন আসে এটা হত্যা না আত্মহত্যা? ঠিক তদ্রুপ শুক্লার বেলায় একই প্রশ্ন তোড়পাড় খেলতে লাগলো একি তার ইচ্ছেকৃত চলে যাওয়া নাকি চলে যেতে বাধ্য করা? প্রশ্ন শুধু প্রশ্নই থেকে যায়, উত্তর আসে না, শুক্লা আসে না।