এস এম জাকির হোসেন শ্যামনগর থেকে ঃ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর জমিদার বাড়িটি এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলার বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম মহারাজ প্রতাপাদিত্যর স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র ভূমি শ্যামনগর। শ্যামসুন্দর নামক একজন ভদ্রলোক প্রয়োজনীয় গৃহাদি নির্মাণের জন্য একখন্ড জমি ইংরেজ সরকারকে দান করেন। সেই থেকে স্থানটির নাম দাতার নামানুসারে ‘শ্যামনগর’ হয়েছে। ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ আমলে সৃষ্টি হওয়া শ্যামনগর উপজেলাটির মোট আয়তন ১৯০৩ বর্গ কিলোমিটার। যার মূল ভূখন্ড ৪৫৫ বর্গ কিলোমিটার এবং সুন্দরবনজুড়ে রয়েছে ১৪৪৮ বর্গ কিলোমিটার। প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে এখানে রয়েছে বংশীপুর ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ, হাম্মামখানা/হাবসিখানা, যশোরেশ্বরী কালী মন্দির, জাহাজঘাটা নৌ দূর্গ, গোপালপুর গোবিন্দ দেবের মন্দির, জমিদার হরিচরণ রায় বাহাদুরের বাসভবন, নহবতখানা ও মন্দির, ঈশ্বরীপুরের জেযুইট গির্জা উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন সময়ে ঐতিহ্যের শ্যামনগরের নকিপুরে অবস্থিত জমিদার হরিচরণ রায় বাহাদুরের বাসভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে কোন প্রজারা হেঁটে গেলে নাকি জমিদারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য পা থেকে জুতা খুলে হাতে নিয়ে জমিদার বাড়ি অতিক্রম করে আবার জুতা পরতো। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক সত্য হলো শ্যামনগরের অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন হরিচরণ রায় বাহাদুরের বাসভবন ‘নকিপুর জমিদার বাড়ি‘টি রক্ষায় এর পাদদেশে নামমাত্র কোন সাইনবোর্ডও এখোনো বসেনি। বর্তমানে প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর নকিপুর জমিদার বাড়ির মূল ভবনটির প্রায় অর্ধেক অংশ ধংসপ্রাপ্ত হয়েছে। আর যে অংশটুকু এখনো টিকে আছে তা কোনরকম সংরক্ষণ বা ব্যবস্থাপনা না থাকায় ধংসের দারপ্রান্তে। সংস্কার আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়িটি ভুতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। জানালা-দরজা না থাকায় বাড়িটি গবাক্ষে রূপ নিয়েছে। বাড়ির দেয়ালে জন্ম নিয়েছে শতশত বটবৃক্ষ। নোনা ধরে ইটের দেয়াল খসে খসে পড়ছে। ইতিহাসের জীবন্ত উপাদান এ বাড়িটি রক্ষায় নেয়া হচ্ছে না কোন উদ্যোগ। স্থানীয়রা মনে করেন নকিপুর জমিদার বাড়িটি ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। শ্যামনগর থানা সদরের ২ কিলোমিটার পূর্বে জমিদার হরিচরণ রায়চৌধুরীর বাড়িটি ১৮৮৮ থ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। বিশাল আকারের তিনতলার ইমারতটি ভাঙাচোরা অবস্থায় এখন কোনরকমে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাজা প্রতাপাদিত্যের পরে হরিচরণ রায় ছিলেন শ্যামনগর অঞ্চলের প্রভাবশালী ও বিত্তশালী জমিদার। তার উদ্যোগে শ্যামনগরে তথা সমগ্র সাতক্ষীরায় অনেক জনহিতকর কাজ হয়েছিল। অনেক জমিদারের মতো হরিচরণ রায় শুধু সম্পদ ও বিলাসে মত্ত ছিলেন না। রাস্তাঘাট, খাল খনন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল নকিপুর মাইনর স্কুলটি। যেটি বর্তমানে নকিপুর সরকারি হরিচরণ পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে খ্যাত। জমিদারবাড়ির সব জিনিসপত্র চলে গেছে চোর ও লুটেদারের দখলে। তবে পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি, এর পাশের দুর্গামন্ডপ, নহবতখানা, শিবমন্দির, জলাশয় ইত্যাদি দেখে সহজে অনুমান করা যায় এর অতীত জৌলুস। দক্ষিণবঙ্গের প্রতাপশালী শাসক রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের ধুমঘাট এলাকায়। তাঁর রাজত্বের প্রায় ২৫০ বছর পরে জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরী শ্যামনগরের নকিপুরে একছত্র অধিপতি ছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর বসতবাড়িটি যা দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থাপত্য হিসেবে পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারতো তা আজ সংস্কার ও দূরদর্শীতার অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শিক্ষক ও লেখক চারু চন্দ্র মন্ডলের লেখা একটি বই থেকে জানা যায়, জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ চৌধুরীর বাড়িটি ছিল সাড়ে তিন বিঘা জমির উপর। যার বাউন্ডারীটি ছিল প্রায় দেড় হাত চওড়া প্রাচীর দ্বারা সীমাবদ্ধ। সদর পথে ছিল একটি বড় গেট বা সিংহদ্বার। সম্মুখে ছিল একটি শান বাঁধানো বড় পুকুর। শতাধিককাল পূর্বে খননকৃত এই পুকুরটিতে সারাবছরই জল থাকে এবং গ্রীষ্মের দিনে প্রচন্ড তাপদাহে তা শুকায় না। পুকুরঘাটের বাম পাশে ছত্রিশ ইঞ্চি সিঁড়ি বিশিষ্ট দ্বিতল নহবত খানা। আটটি স্তম্ভ বিশিষ্ট এই নহবত খানার ধ্বংসাবশেষটি এখনও প্রায় অক্ষত অবস্থায় দন্ডায়মান থেকে কালের স্বাক্ষী বহন করছে। বাগান বাড়িসহ মোট বার বিঘা জমির উপর জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাড়িটি ছিল দৈর্ঘ্য ২১০ ফুট, প্রস্থ ৩৭ ফুট, পুনঃ ৬৪ ফুটের মাথায় এল প্যাটার্নের বাড়ি। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই সম্মুখে সিঁড়ির ঘর। নিচের তলায় অফিসাদি ও নানা দেবদেবীর পূজার ঘর, এছাড়া আরও দুইটি গমনাগমন সিঁড়ি পথ। মাঝের তলায় কুল দেবতা গোপাল দেবের মন্দির ও অতিথি শালা। সিঁড়ির দু’পাশে কক্ষ ছিল এবং সিঁড়ি ছিল মধ্যবর্তী স্থানে। সদর অন্দরের দুই পাশেই বারান্দা ছিল। বারান্দাগুলি বেশ প্রশস্ত আট ফুট চওড়া। বিল্ডিং এর নীচে আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল। নিচের তলায় ১৭টি এবং উপরের তলায় ৫টি কক্ষ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ছোট, বড়, মাঝারি সব রকমের কক্ষ ছিল। প্রথমবার ঢুকলে কোন দিকে বহির্গমন পথ তা বোঝা বেশ কষ্টদায়ক। চন্দন কাঠের খাট-পালঙ্ক, শাল, সেগুন, লৌহ কাষ্ঠের দরজা-জানালা ও বর্গাদি, লোহার কড়ি, ১০ ইঞ্চি পুরু চুন-সুরকির ছাঁদ, ভিতরে কক্ষে কক্ষে গদি তোষক, কার্পেট বিছানো মেঝে, এক কথায় জমিদার পরিবেশ, যেখানে যেমনটি হওয়া দরকার তার কোন ঘাটতি ছিল না। বাড়িতে ঢুকতে ৪টি গেট ছিল। গেট ৪টি ছিল ২০ ফুট অন্তর। জমিদার বাড়ির দক্ষিণে একটি বড় পুকুর ছিল। ১৯৫৪ সালের জমিদার পরিবার এখান থেকে স্ব-পরিবারে ভারতে চলে যায়।বর্তমান সে পুকুরটি আর নেই। নেই পূর্বের মত সৌন্দর্য। তবে তার দক্ষিণে এখনও একটি পুকুর বিদ্যমান যার শান বাঁধানো ঘাটের ধ্বংসাবশেষটির দুই পাশে দুটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। নকিপুর জমিদার বাড়িটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে বাড়িটিকে পূর্বের নান্দনিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তৎকালীন জমিদার বংশের গৌরবময় ঐতিহ্যের নানা নির্দশন পাওয়া যায় এ বাড়িতে। বাড়িটি সংরক্ষণে ইতোমধ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিন্তু এর বাস্তবায়নের নিদর্শন এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি।