এড. তপন দাস \ কাউকে ভালবাসতে চাইলে তার সম্পর্কে জানতে হবে, তাকে চিনতে হবে তবেই তাকে প্রকৃত ভালবাসা যায়। তেমনি একটি দেশে জন্মালেই সেই দেশ আপন হয় না। দেশকেও জানতে হবে, এর ইতিহাস খুঁজতে হবে। তবেই সে দেশকে ভালবাসা যাবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি একটি মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল। একটি লোকায়িত জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আত্মপরিচয়ের সুদীর্ঘ সংগ্রামে লিপ্ত। সুখে-দুঃখে এক হয়ে বেঁচে থাকার সুতীব্র আকাঙ্খাই বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র গঠনে অনুপ্রেরণা যোগায়। আর সেই অনুপ্রেরণার সূত্র ধরেই আসে মহান একাত্তর। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসের সব থেকে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আদি অনুপ্রেরণার উৎস খুঁজে পেতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এক অনন্য দলিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে অনূদিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে বাংলাদেশের মুজিবনগরে ঘােষিত ও জারিকৃত হলেও ২৩ মে ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তবে আইনের ছাত্র বা আইনের অঙ্গনে যাদের বিচরণ তাদের কাছে অনেকটা অজানা বা অগুরুত্বপূর্ণ রয়ে গেছে এই ঘোষণাপত্র। আমার লেখার শিরােনাম পড়লেই বোঝা যাবে— স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের একটি সহজ-সরল অথচ প্রয়োজনীয় ভাব-বর্ণনা পাওয়া যাবে এই লেখায় যা উপকৃত করবে দেশপ্রেমিক সকলকে। বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ১৯৭০ সনের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সনের ১৭ জানুয়ারী পর্যন্ত জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সংবিধান প্রণয়ন করা। উক্ত নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ মোট ১৬৯ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেন যারা ছিলেন আওয়ামীলীগ দলীয় সদস্য। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জনপ্রতিনিধিদের মিলিত হবার জন্য ১৯৭১ সনের ৩ মার্চ দিন ধার্য করেন এবং সকল জনপ্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানান। পরবর্তীতে তিনি অন্যায়ভাবে উক্ত সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। অন্যদিকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাদের প্রতি আরােপিত অঙ্গীকার পালন না করে বরং বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায়রত অবস্থায় একটি অনৈতিক ও বিশ্বাসহন্তা যুদ্ধ ঘোষনা করে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের বৈধ অধিকার পূরণের লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ ঢাকায় স্বাধীনতার সময়োচিত ঘােষনা দেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখন্ডতা রক্ষার জন্য এ জনপদের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ নৃশংস, অসভ্য ও অন্যায় যুদ্ধ দ্বারা বাংলাদেশে নজিরবিহীন গণহত্যা সংঘটন করে এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বপ্নকে পর্যদুস্ত করার অপপ্রয়াস গ্রহণ করে। বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী ঐকান্তিকতা দিয়ে বাংলাদেশ এলাকায় কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। জনপ্রতিনধিগণ জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতি সশ্রদ্ধ অনুগত ও দীক্ষিত হয়ে যথাযথ ভাবে সংবিধান রচনার নিমিত্ত গণপরিষদ গঠন করেন এবং নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক পরামর্শ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ’ নামক সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান করা হয়। অধিকন্তু এর দ্বারাই তাে পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন। রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক হবেন এবং ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা তার হাতে ন্যস্ত থাকবে। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রদান করবেন এবং কর ধার্য, আদায় ও অর্থ ব্যয় করার ক্ষমতা তার উপর অর্পিত থাকবে। গণপরিষদ আহ্বান ও মূলত বিচার ক্ষমতা তাঁর উপর ন্যস্ত থাকবে। মোটকথা, বাংলাদেশের জনগণের একটি সুশৃঙ্খল ও আইনসম্মত সরকার উপহার দেবার জন্য রাষ্ট্রপতি যেরুপ প্রয়োজন বোধ করবেন সেরুপ কার্য করবেন। বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির যাবতীয় ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপতি পালন ও প্রয়োগ করবেন। অধিকন্তু জাতিসমূহের পরিবারভূক্ত একজন সদস্য হিসাবে জাতিসংঘের সনদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার অঙ্গীকার প্রদান করা হয়। আরো সিদ্ধান্তিত হয় যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ হতে কার্যকর হয়েছে মর্মে বিবেচিত হবে। আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, এই দলিল কার্যকর করার জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতিকে শপথ পাঠ করাতে হবে এবং উক্ত শপথ পরিচালনার জন্য অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে যথাযথ ক্ষমতার্পণ করা হয়। সবশেষে বলতে চাই, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল আকাংখা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা একটি সত্য সুন্দর, কল্যাণ ও আনন্দের বিচার ব্যবস্থা চেয়েছি এবং সেটি বাস্তবায়ন করতে গেলে একটি সুস্থতর, সুন্দরতর ও সমৃদ্ধতর বাংলাদেশ গঠন করতে হবে। সে লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। আমরা সেই অরুনোদয়ের অগ্নিসাক্ষী হতে চাই যে সকালের অমিত সম্ভাবনা আমাদেরকে নিয়ে যাবে একটি আদর্শ, উন্নত ও কল্যাণকর রাষ্ট্রে। আমাদের পূর্বপুরুষের এতো মহিমান্বিত আত্মত্যাগ-সেকি সফল হবে না? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় আশাবদী হয়ে দাবী নিয়ে আমিও বলতে চাই,
“বীরের এ রক্তস্রোত,
মাতার এ অশ্র“ধারা
এর যত মূল্য সেকি ধরার ধুলায় হবে হারা।
স্বর্গ কি হবেনা কেনা।
বিশ্বের ভান্ডারী শুধিবেনা
এত ঋণ?
রাত্রির তপস্যা সেকি আনিবে না দিন”।