মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:৩৪ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::
প্রতিনিয়ত ভাংগনে ইছামতি ও কালিন্দী নদী \ ছোট হয়ে আসছে সাতক্ষীরা \ বাংলাদেশ হারাচ্ছে ভূ—খন্ড \ স্থায়ী সমাধান জরুরী প্রয়োজন মেগা প্রকল্প গ্রহণ \ এখনই সময় দেবহাটা সর: পাইলট হাইস্কুলের শহীদ মিনার উদ্বোধনী ও পুরস্কার বিতরণ দেবহাটা রিপোটার্স ক্লাবের শীতবস্ত্র বিতরণ দেবহাটায় তারুণ্যের উৎসব উদযাপনে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শ্যামনগরে গর্ভবতী গরু জবাই \গ্রাম্যমান আদালতে ব্যবসায়ীকে জরিমানা সাতক্ষীরায় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট উদ্বোধন সাতক্ষীরায় প্রেসব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম রসুলপুর জান্নাতুল ফিরদাউস কুরআনিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার ছাদ ঢালাই উদ্বোধন ডুমুরিয়ার বিল ডাকাতিয়ায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর আবাদী জমিতে বোরো চাষ অনিশ্চিত খুলনায় যুবদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

৫০ বছর ধরে পতাকা তৈরি করে আসছেন ফ্লাগ আঙ্কেল মির্জা আনোয়ার

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় সোমবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

কয়রা (খুলনা) প্রতিনিধি \ বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর তখন থেকেই জাতীয় পতাকা তৈরি করে আসছেন দর্জি আনোয়ার হোসেন। এখন তার বয়স ৭০ বছর। সারা বছর ধরে জাতীয় পতাকা তৈরি করে এলেও স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পতাকা তৈরির হিড়িক পড়ে তার দোকানে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আনোয়ার হোসেন মির্জা জানান, তার তৈরি পতাকা যেমন ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন, তেমনি ১৬০ থেকে ১৮০ ফুট দীর্ঘ পতাকা বিক্রি করেন প্রায় ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস এলেই সাধারণ মাপের পতাকা না লাভ না ক্ষতি নীতিতে ন্যূনতম মূল্যে বিক্রি করে থাকেন জাতীয় পতাকা। এটা করতে গিয়ে তার স্বগোক্তি, আমি দেশকে ভালবাসি তাই দেশের জন্য এটা করি। সত্তর ছুঁই ছুঁই মানুষটার জীবনের গল্প শুনে সরাসরি বাক্যালাপ শুনে, মৌখিক থেকে লিখিত রুপে প্রস্তুত করেছেন শাহজাহান সিরাজ। পরস্পরাভাবেই তারা জাতীয় পতাকা তৈরি করে আসছেন। তার বাবা আফসার উদ্দীন সংগ্রামীদের জন্য খাদি কাপড়ের জাতীয় পতাকা তৈরি সরবরাহ করতেন। সেই থেকে জাতীয় পতাকা নির্মাণ পারিবারিক ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও তা নো প্রফিট নো লস চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে। তার বাবা আফসার মির্জা এই পতাকা তৈরির বিষয়টি তার হাতে অর্পণ করেছিলেন। খুলনার খালিশপুরে আমাদের আদি বাড়ি। খালিশপুর ক্রিসেন্ট জুট মিলের সামনে ছিল আব্বার (মির্জা আফসার উদ্দীন) দর্জির দোকান। ছোটবেলা থেকে আব্বাকে সেলাইয়ের কাজে সহযোগিতা করতাম। এই করতে করতেই সেলাইয়ের কাজটা শিখে নিয়েছিলাম। তবে পতাকা বানানোর সঙ্গে মিশে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। নবম শ্রেণিতে পড়তাম। এমনও দিন গেছে, খাবার পাইনি, রাতে ঘুমাতে পারিনি। খিদে লাগলেও আওয়াজ কো কাঁদতে পারি নি ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। তখন এলাকাতেই ছিলাম। তেমন কিছুই বুঝি না। তবে তখনকার স্মৃতি মনে আছে। গ্রামের ঘরবাড়ি জ¦ালিয়ে দেওয়া, মানুষের লাশ পড়ে থাকা দেখেছি। লুটপাটের শিকার হয়ে অনেকেই সবকিছু ফেলে দেশ ছেড়েছেন————তা—ও দেখেছি। পালিয়ে কিছু স্বজন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। আবার তাঁরা অস্ত্র হাতে ফিরে এসেছেন। আব্বার দর্জির দোকানে দেখতাম মুক্তিবাহিনীর লোকজন আসতেন। কেউ কেউ দোকানে অস্ত্রশস্ত্রও লুকিয়ে রাখতেন। তাঁদের কাছে সারা দেশের যুদ্ধের খবর নিতাম। ১৬ ডিসেম্বর দেশ বিজয়ের খবরও তাঁদের কাছে জেনেছিলাম; কিন্তু সেদিনও আমাদের এলাকা হানাদারমুক্ত হয়নি। পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর সকালে খালিশপুর গোলচত্বরে স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন করতে গিয়েও পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে একজন শহীদ হন। সকালের ঘটনার পর চিন্তা করেছিলাম আমি তো সেলাইয়ের কাজ পারি, আজ নিজেই পতাকা তৈরি করব। তখন তো পতাকায় সবুজের ওপর লাল সূর্যের মধ্যে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র ছিল। প্রথমবার অনেক চেষ্টা করে তৈরি করলাম। আমার তৈরি করা প্রথম পতাকাটা মুক্তিবাহিনীর লোকজন নিয়ে উড়িয়েছিলেন। সেদিনই খালিশপুর শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। সেই থেকেই জাতীয় পতাকা তৈরি শুরু। স্বাধীন বাংলাদেশে পতাকার বেশ চাহিদাও ছিল। বানিয়ে বানিয়ে বিক্রি করতাম। পাশাপাশি অন্যান্য কাপড় সেলাইয়ের কাজও করতাম। মির্জা আনোয়ার আরও বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লাল সবুজের পতাকা নিয়ে বিজয় উৎসব দেখেছেন। তখনই বুঝেছেন এই পতাকার জন্যই দেশের মানুষ এত কষ্ট করেছেন, রক্ত দিয়েছেন। সবকিছু বেশ ভালোই চলছিল। ১৯৮৫ সালে আব্বা মারা যান। সংসারে আরেকটু সচ্ছলতার জন্য বিদেশে যেতে চেয়েছিলাম। এ জন্য দোকানঘর বিক্রি করে তার সঙ্গে আরও কিছু টাকা ঋণও নিই। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সব টাকা এক দালালের কাছে দিয়ে প্রতারিত হই। ঘাড়ের ওপর ঋণের বোঝা আর অসম্মানের সঙ্গে এলাকায় থাকাটা একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন। বাধ্য হয়ে পরিবারসহ সাতক্ষীরার আশাশুনি এলাকায় চলে যাই। পরবর্তীকালে জমি বিক্রি করে সেই ঋণ শোধ করি। তবে খালিশপুরে আর ফেরা হয়নি। এরপর ২০০১ সালের দিকে কয়রায় চলে আসি। তবে যেখানেই থেকেছি, পতাকা তৈরি করেছি। জাতীয় পতাকা তৈরি করি মনের তাগিদে : কয়রা উপজেলার যত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন আছে, সব প্রতিষ্ঠান আমার কাছ থেকেই জাতীয় পতাকা বানিয়ে নেয়। এ ছাড়া দূরের কাস্টমাররাও আছেন। তাঁরা মোবাইল করে পতাকার অর্ডার দেন। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস আর একুশে ফেব্রুয়ারির (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস) সময় আমার বানানো পতাকা ভালো বিক্রি হয়। তবে ডিসেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি। ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকেও অনেক অর্ডার থাকে। এ সময় কাপড় কেটে এলাকার নারীদের কাছে সেলাই করতে দিই। এ ছাড়া ফুটবল ও ক্রিকেট বিশ্বকাপ ঘিরেও পতাকার চাহিদা থাকে। সে সময় অন্য দেশের পতাকাও বানাই। তবে বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করি মনের তাগিদে। জাতীয় পতাকা বানানো আমার শুধু পেশা নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। বছরের অন্য সময় যখন পতাকা বেচাবিক্রি বেশি হয় না, তখন অন্য কাপড়চোপড়ও সেলাই করি; কিন্তু পতাকা বানানোর এই কাজ ছাড়ি না। দীর্ঘদিন পতাকা বানানোর সঙ্গে যুক্ত থাকায় এখানকার অনেকেই আমাকে ফ্লাগ চাচা বা ‘পতাকা চাচা’ বলেও ডাকেন। ভালোই লাগে শুনতে। আমার কাছে অনেক ধরনের পতাকা আছে। কয়রা থেকেই কাপড় কিনে বানাই। ছোট পতাকা বিক্রি করি ১০ টাকা, মাঝারি আকারের ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা আর একটু বড় আকারেরটা ৫০ টাকায়। প্রতিটি পতাকা বানানোর সময় দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বৃত্ত ঠিক করে কাপড় কাটি। পাঁচ মেয়ে আর এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রী মারা গেছে ২০১৪ সালে। একমাত্র ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অল্প বেতনে চাকরি করে। একাই থাকি কয়রায়। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে কয়েক কিলোমিটার দৌড়াই। মাঝে মাঝে সকালে ছেলেদের সাথে ফুটবলও খেলি। শরীরে কোনো রোগবালাই নেই, জীবনে কোনো আফসোসও নেই। তাই তো নতুন প্রজন্মের সামনে জাতীয় পতাকার মহাত্ম্য তুলে ধরতে এ কাজ ধরেছেন। যতদিন বেঁচে থাকবেন, এভাবেই লাল সবুজের জাতীয় পতাকা তৈরি করে নতুন প্রজন্মের কাছে হাজির হবেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com