এফএনএস: ৯ মার্চ, ১৯৭১। পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানী বললেন, “শেখ মুজিব নির্দেশিত সময়ের মধ্যে যদি কোনো সমাধান না আসে, তবে আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ১৯৫২ সালের মতো আন্দোলন শুরু করব।” তিনি পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, “অনেক হয়েছে, আর নয়। তিক্ততা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই।” এই বক্তব্যের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ টেলিফোন সংলাপ হয়। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় নতুন দিকনির্দেশনার সূচনা। এদিন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। একইসঙ্গে, কয়েকদিনের আন্দোলনে শহীদ ছাত্রনেতা ফারুক ইকবালসহ অন্যান্যদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারাদেশ অচল হয়ে পড়ে। সরকারী—বেসরকারী দফতর, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবই ছিল বন্ধ। তবে জরুরি কাজের জন্য কিছু অফিস খোলা রাখা হয়েছিল। সরকারের অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে না পারে, সে জন্য ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান মাত্র তিন ঘণ্টা খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরদের উদ্দেশে বলেন, “এখন অনেক খেলা হবে, অনেক ষড়যন্ত্র চলবে। আমাদের প্রত্যেককে সজাগ থাকতে হবে এবং যেকোনো মূল্যে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।” এদিনই পূর্ব পাকিস্তানে গবর্নর হিসেবে নিযুক্ত করা হয় বেলুচিস্তানের ‘কসাই’ খ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের দমন—পীড়নের পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে, জনগণকে ধোঁকা দিতে ইয়াহিয়া খানের ঢাকা সফরের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও বাঙালিদের দমনের ছক কষা হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারকে সাহায্য করতে মানুষ দলে দলে অর্থ, খাদ্য ও রক্ত দান করতে এগিয়ে আসে। অন্যদিকে, গোপনে দেশের অন্তত ৬০—৭০টি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ চালানো হচ্ছিল। ছাত্র—যুবকদের সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল। সংগঠিতভাবে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের কাজও চলছিল জোরকদমে। বঙ্গবন্ধু বারবার কর্মীদের সতর্ক করে বলেছিলেন, “কোনো উসকানির ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। আমাদের আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ।” তাঁর এই দৃঢ় নেতৃত্বেই সারাদেশে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রক্রিয়া আরও বেগবান হয়। অগ্নিঝরা মার্চের প্রতিটি দিনই ছিল একেকটি ইতিহাস। দেশের প্রতিটি মানুষ তখন অপেক্ষায়, সামনে এগিয়ে চলার, স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার। জাতির জনকের আহ্বানে বাংলার দামাল ছেলেরা নিজেদের প্রস্তুত করছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য, যে মুহূর্তের জন্য একটি জাতি যুগের পর যুগ অপেক্ষা করেছিল।