স্বাধীনতার অগ্নিশপথ
এফএনএস: আজ ৮ মার্চ, বাঙালির ইতিহাসে এক অগ্নিঝরা দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে সমগ্র দেশজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর জাতির মনে স্বাধীনতার অগ্নিশপথ জ্বলে ওঠে। দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন—সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কার্যত স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশব্যাপী মানুষ অস্ত্রহীন হয়েও প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। একদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমনপীড়ন, অন্যদিকে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের প্রস্তুতিÑপুরো দেশ যেন তখন এক অগ্নিগর্ভ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। শহর, বন্দর, গ্রাম—গঞ্জে বাঙালিরা সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য সংগঠিত হতে থাকে। এই দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের প্রতীকসমূহ বর্জন করা শুরু হয়। সরকারি—বেসরকারি ভবন থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়, সিনেমা হলে উদুর্ ছবি প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পাকিস্তানি জাতীয় সংগীত বাজানো নিষিদ্ধ হয়। সচিবালয়, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন দপ্তরে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকে। কেবলমাত্র বেতন উত্তোলনের জন্য ব্যাংকগুলো সীমিত সময়ের জন্য খোলা রাখা হয়। এদিকে, ঢাকার বিমানবন্দরে দেখা যায় আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলোর বেশ কিছু উড়োজাহাজ অপেক্ষমাণ। এগুলো সাধারণত ঢাকায় আসে না, কিন্তু সেদিন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ ছিল স্পষ্টÑঢাকার পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে, আর তাই বিদেশিরা নিরাপদে ঢাকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে বাঙালিরা তখন আর পিছু হটার পাত্র নয়, তারা দেশ রক্ষার জন্য সর্বস্ব বাজি রাখার শপথ নিয়ে এগিয়ে চলেছিল। ৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে প্রচার না করার কারণে জনগণের ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। জনগণের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়ে ৮ মার্চ সকাল ৮টায় রেডিও পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সম্প্রচার করা হয়। সেই ভাষণের প্রতিটি বাক্য যেন জনগণের অন্তরে বিদ্যুৎ প্রজ্বলিত করে, আরেক দফা আন্দোলনের আগুন জ্বেলে দেয়। ৮ মার্চের এই উত্তাল পরিবেশে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ তাদের নাম থেকে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়, যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ছাত্র—তরুণদের মিছিল আর স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে রাজপথ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলতে থাকে। যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলার নির্দেশ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। এই দিন থেকেই বাঙালি জাতি আরও সুসংগঠিত হতে থাকে। শহর থেকে গ্রাম, বন্দর থেকে হাটÑসর্বত্রই মানুষ প্রস্তুতি নিতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য। জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পরবর্তীতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। ৮ মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিন আজও আমাদের প্রেরণা জোগায়, স্বাধীনতা রক্ষার শপথ করায়। এই দিনের ইতিহাস স্মরণে আমরা আমাদের স্বাধীনতার চেতনা অটুট রাখার সংকল্প গ্রহণ করি।