মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫, ০১:২৭ পূর্বাহ্ন

অগ্নিঝরা মার্চ’ ৭১

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০২৫

অসহযোগ আন্দোলনের চতুর্থ দিবস
এফএনএস: আজ ১১ মার্চ, ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের এক স্মরণীয় দিন। অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের চতুর্থ দিবস হিসেবে এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারাদেশে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বঙ্গবন্ধুর নীতিমালার ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়। গত কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সারাদেশে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। দলীয় স্বেচ্ছাসেবকরা রাতের বেলা রাজধানীতে টহল কার্যক্রম পরিচালনা করে, যাতে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো শক্তি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। ফলে ঢাকায় শৃঙ্খলা বজায় থাকে। সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী যেসব যানবাহন ও প্রতিষ্ঠান চালু থাকার কথা ছিল, সেগুলো স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকে। ১১ মার্চ, বৃহস্পতিবার; ১৯৭১, সারাদেশের সরকারি ও আধা—সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা—কর্মচারীরা কর্মবিরতি অব্যাহত রাখেন। বিচারপতি থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করে। মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। এই দিনে বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলে এক জনসভায় বলেন, “সাত কোটি বাঙালির নেতা শেখ মুজিবের নির্দেশ পালন করুন।” জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান সামরিক সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “এক রাষ্ট্রের জোয়ালে আবদ্ধ না থাকলেও দুটি স্বাধীন ভ্রাতৃরাষ্ট্র হিসেবে আমরা পরস্পরের এবং বিশে^র এই অংশের সমৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারবো।” ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। এ ছাড়া, পাঞ্জাব প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সভাপতি খুরশীদ হক, কাম্বেলপুরের মুসলিম লীগ নেতা পীর সাইফুদ্দীন এবং জাতিসংঘের উপ—আবাসিক প্রতিনিধি কে. উলফ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন। আলোচনাগুলোর মূল বিষয় ছিল রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন ও আন্দোলনের ভবিষ্যৎ গতিপথ। বরিশালে এদিন কারাগার ভেঙে ২৪ জন কয়েদি পালিয়ে গেলে পুলিশের গুলিতে ২ জন নিহত হয় এবং ২০ জন আহত হয়। কুমিল্লায় পুলিশের গুলিতে ৫ জন নিহত হয় এবং শতাধিক আহত হয়। এ ধরনের দমন—পীড়ন সত্ত্বেও আন্দোলন দমে যায়নি, বরং আরও বেগবান হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমিতভাবে সচল রাখা হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী পরিচালিত হয়, শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কৃষি উৎপাদন, বন্দর পরিচালনা, বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ অব্যাহত রাখা হয়। সর্বোচ্চ কৃচ্ছ্রতা সাধনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় চার নেতা ও অন্যান্য শীর্ষ নেতৃবৃন্দ প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তার দক্ষ সংগঠক হিসেবে ভূমিকা এদিন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের উপ—আবাসিক প্রতিনিধি কে. উলফ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যার ষড়যন্ত্র করছে, তাই মানবতার স্বার্থে আপনাদের দেশ না ছাড়ার অনুরোধ জানাই।” এই সময়েই পশ্চিম পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে চাপে ফেলার চেষ্টা চালায়। সামরিক জান্তা ও জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে আপসের মাধ্যমে সমাধানের জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার নীতিতে অবিচল থাকেন। ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন, যা রাজনৈতিক আলোচনার নতুন দিক উন্মোচন করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা সামরিক সরকারের দেওয়া যাবতীয় খেতাব ও উপাধি বর্জনের ঘোষণা দেন। তারা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তাজউদ্দীন আহমেদের স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, “জনগণের আন্দোলন নজিরবিহীন তীব্রতা লাভ করেছে। অসহযোগ আন্দোলন সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে, কারণ জনগণ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে পালন করেছে। অর্থনীতি সচল রাখার মাধ্যমে আমরা শত্রুর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেব।” বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী ব্যাংক, বন্দর, কৃষি কার্যক্রম, সাহায্য ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালু রাখা হয়। একইসঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়। অসহযোগ আন্দোলনের এই দিনগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রস্তুতি পর্ব। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় একটি জাতি শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত ও কর্মকৌশল বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ নেতৃত্বের পরিচয় বহন করে। আজ যখন সেই উত্তাল সময়ের দিকে ফিরে তাকাই, তখন স্পষ্ট হয়, কীভাবে একটি জাতি দৃঢ় সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে গিয়েছিল। ১১ মার্চের প্রতিটি ঘটনা বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক একটি সোনালি অধ্যায় হয়ে থাকবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com