উত্তাল রাজপথ, নতুন চেতনার উন্মেষ
এফএনএস: ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চÑএক উত্তাল দিন, এক সংগ্রামী অধ্যায়। এদিন ঢাকার রাজপথে দেখা যায় এক অভিনব দৃশ্য। রাজনৈতিক কর্মী বা ছাত্রদের মিছিল নয়, দাঁড়—বৈঠা হাতে রাজপথ দখল করে নেমে আসে মাঝিমাল্লারা। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তাদের ক্ষোভ—প্রতিবাদ বয়ে যায় ঢাকার অলিগলিতে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ ছিল এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছিল। সামরিক আইনের ১১৫ ধারা জারির প্রতিবাদে বেসরকারি কর্মচারীরাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। খ্যাতিমান শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সামরিক জান্তার দমননীতির প্রতিবাদে ‘হেলাল ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেন। শুধু রাজনৈতিক নেতা নয়, দেশের সংস্কৃতিজগতের ব্যক্তিত্বরাও সরব হয়ে ওঠেন। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দেনÑযদি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সত্যিকারের সদিচ্ছা নিয়ে আলোচনায় বসতে চান, তাহলে তিনি আপত্তি করবেন না। তবে আলোচনার জন্য শর্তও দেন তিনিÑআন্দোলনের দাবিগুলো পূরণের প্রতিশ্রম্নতি দিতে হবে এবং আলোচনায় কোনো তৃতীয় পক্ষ থাকতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তিনি বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো রকম ছাড় দিতে প্রস্তুত নন। ঢাকায় যখন বাঙালিরা মুক্তির লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ, তখন করাচীর নিস্তার পার্কে আয়োজিত এক জনসভায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি দাবি তোলেন, সংসদের বাইরে সংবিধানসংক্রান্ত সমঝোতা ছাড়া ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব নয়। তিনি এমনকি বলেনÑপূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে পৃথক দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতা রুখতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ষড়যন্ত্র করে যাবে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেও কিছু গণতান্ত্রিক শক্তি তখন বাঙালির আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে শুরু করে। ন্যাপ (ওয়ালী) নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বাঙালির আন্দোলনকে সম্পূর্ণ ন্যায্য বলে ঘোষণা করেন। একই দিনে জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান অস্থায়ী সরকার গঠনের দাবি জানান, যা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ ১৫ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন পালনের জন্য ৩৫টি নতুন নির্দেশনা জারি করেন। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পরিচালিত হচ্ছিল। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি সংগঠন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছিল। বায়তুল মোকাররমের সামনে ছাত্র ইউনিয়নের এক সমাবেশে ঘোষণা দেওয়া হয়Ñদেশের সাত কোটি মানুষকেই সৈনিক হিসেবে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে আয়োজিত এ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। একই দিনে দেশের শিল্পী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা ‘শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন, যা সাংস্কৃতিক জগতে মুক্তিসংগ্রামের অঙ্গীকারকে আরও সুসংহত করে। ১৪ মার্চের এই ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে, শুধু রাজনৈতিক নেতারা নয়, সাধারণ মানুষ, মাঝিমাল্লা, শিল্পী, ছাত্র, চাকরিজীবীÑসমাজের সর্বস্তরের মানুষই তখন স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেছে। বাঙালির চূড়ান্ত স্বাধীনতা তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তানি শাসকদের কূটকৌশল আর দমননীতি সেদিন হার মেনেছিল বাংলার সংগ্রামী জনতার ঐক্যের কাছে।