সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ০১:১২ পূর্বাহ্ন

অগ্নিঝরা মার্চ’ ৭১

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫

আলোচনার ছলনা ও ষড়যন্ত্রের অন্ধকার
এফএনএস: ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। টানা ১৪ দিন ধরে গোটা দেশ অচল করে রেখেছিল বাঙালি, প্রতিটি মানুষ একটাই স্বপ্ন দেখছিলÑস্বাধীনতা। এই দিনেও তৃতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন বঙ্গবন্ধু। তবে আলোচনার টেবিলে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন দৃঢ় ও অটল, আর ইয়াহিয়া খান ছিলেন ষড়যন্ত্র ও সময়ক্ষেপণের খেলায় ব্যস্ত। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু জনগণের গণতান্ত্রিক রায়ের ভিত্তিতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এটিকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিতেও প্রস্তুত নয়, বরং তারা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে চাইছে। বৈঠক ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে আসেন। তাঁর গাড়িতে তখনো উড়ছিল প্রতিবাদের প্রতীক কালো পতাকা এবং স্বাধীনতার প্রতীক বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা। গাড়ি থেকে নামার পর সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। আলোচনার ফলাফল জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ত উত্তর দেনÑ“বলবার সময় আসেনি।” তবে সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সংগ্রাম জোরদার হতে পারে।” এই সংবাদ দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আর মুহূর্তেই ঢাকার রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ, ছাত্রসমাজ, রাজনৈতিক নেতারা বুঝতে পারেন, পাকিস্তান সরকার আলোচনার নামে কেবল ধোঁকা দিচ্ছে। বায়তুল মোকাররম এলাকায় ছাত্র ইউনিয়নের এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্রনেতারা ঘোষণা করেনÑ“বাংলার মানুষ এখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। আর কোনো বৈঠকের প্রয়োজন নেই। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।” বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু আলোচনার পথ খোলা রেখেছিলেন, কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভিন্ন কিছু পরিকল্পনা করছিলেন। গভীর রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি জেনারেলদের এক গোপন বৈঠকে নেওয়া হয় এক নৃশংস সিদ্ধান্ত। প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন টিক্কা খান। এই বৈঠকে জেনারেল খাদেম হোসেন রাজাকে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। অর্থাৎ, বাংলাদেশের মানুষকে চূড়ান্তভাবে দমন করতে সামরিক বাহিনীকে গণহত্যার জন্য প্রস্তুত করা হয়। এই রাতেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ভয়াবহ গণহত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিলÑবাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে নিমূর্ল করা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে রক্তের ে¯্রাতে ভাসিয়ে দেওয়া। এই ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেনÑ“সামরিক কতৃর্পক্ষ নিযুক্ত তদন্ত কমিশন মানি না।” তাঁর এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয়, তিনি পাকিস্তানি শাসকদের আর বিশ^াস করেন না। ১৭ মার্চের রাতের ষড়যন্ত্রই ছিল ২৫ মার্চের গণহত্যার সূচনা। আলোচনার নামে পাকিস্তান সরকার ধোঁকা দিচ্ছিল, আর গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল বাঙালি নিধনের। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিলÑবাংলার স্বাধীনতার অগ্নিশিখা তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে, দমন করে রাখা আর সম্ভব নয়। এই দিনের ঘটনার পর পুরো জাতি বুঝে যায়, স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র পথ হলো যুদ্ধ। বাংলার জনগণ প্রস্তুত হচ্ছিল, ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক লড়াইয়ের জন্য।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com