বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:১১ অপরাহ্ন

অডিট নিয়ে চরম দ্বন্দ্বে সরকারি দুই সংস্থা

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

এফএনএস : অডিট নিয়ে চরম দ্বন্দ্বে সরকারি দুই সংস্থা। পাবলিক অডিট বিল—২০২৪ নিয়ে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। আর ওই দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়কে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সরকারি সব আয়—ব্যয়ের নিরীক্ষণের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এমনকি নিরীক্ষা কতৃর্পক্ষের এনবিআরের বিভিন্ন কার্যালয়ে নিরীক্ষারও এখতিয়ার রয়েছে। তবে নিরীক্ষা কতৃর্পক্ষ এনবিআরের বিভিন্ন দপ্তরে অডিট বা নিরীক্ষা করতে মাঝেমাঝেই অসহযোগিতামূলক আচরণের শিকার হয়েছে। ওই বিরোধের জেরে চিঠি চালাচালি থেকে শুরু করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়েও দুই কতৃর্পক্ষের দ্বন্দ্ব কমেনি। বরং নতুন করে পাবলিক অডিট বিল—২০২৪ প্রণয়ন কেন্দ্র করে এ দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সমপ্রতি পাবলিক অডিট বিল—২০২৪ এর খসড়ায় সরকারের সংযুক্ত তহবিলে প্রাপ্ত অর্থ নির্ধারণের পদ্ধতি সঠিক কিনা, তা যাচাই—বাছাই করতে নিরীক্ষা অধিদপ্তরকে অধিকার দিতে নারাজ। এনবিআর বিলের খসড়ায় যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছে, সাংবিধানিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত নিরীক্ষা কতৃর্পক্ষকে রাষ্ট্রের সব আয়—ব্যয়ের এখতিয়া দেয়া হলেও আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও কাস্টমস আইনের ওপর নিরীক্ষা কতৃর্পক্ষের ক্ষমতা নেই। তবে যে সব রাজস্ব সংযুক্ত তহবিলে প্রাপ্য তা সঠিকভাবে নির্ধারণ, জমা ও হিসাবভুক্ত হয়েছে কিনা, রাজস্ব নিরূপণ বা অ্যাসেসমেন্ট আইনসম্মত হয়েছে কিনা, তা যাচাই করতে পারবে নিরীক্ষা কতৃর্পক্ষ। কিন্তু এনবিআর নিরূপণ পদ্ধতিতে নিরীক্ষা কতৃর্পক্ষ আপত্তি জানিয়েছে। এনবিআরের দাবি— ২০২৩ সালে প্রণীত আয়কর আইন ও কাস্টমস আইনের ৩ ধারা ও মূল্য সংযোজন কর ২০১২ এর ৩ ধারায় উল্লিখিত বিষয় দেশের সব আইনের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে। কিন্তু আইনজ্ঞদের মতে, সিএজি (অ্যাডিশনাল ফাংশন) অ্যাক্ট—১৯৭৪ এর ৫ (১) ধারায় প্রদত্ত সিএজি ক্ষমতাবলে বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান, পাবলিক এন্টারপ্রাইজ এবং স্থানীয় কতৃর্পক্ষসমূহ অডিট করে। সংবিধানে সিএনজিকে অডিটের পরিধি এবং ব্যাপ্তি নির্ধারণের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। আয়কর, শুল্ক ও মূসক আইনে কর বা শুল্ক নির্ধারণ (অ্যাসেসমেন্ট) বিষয়ে কর কতৃর্পক্ষ ও আদালত ছাড়া কারোর প্রশ্ন তোলার এখতিয়ার নেই বলে এনবিআরের দাবি। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের ওপর রাষ্ট্রের সব আয় ও ব্যয়ের নিরীক্ষার দায়িত্ব। অথচ এনবিআরের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে ওসব দায়িত্ব তারা ঠিকমতো পালন করতে পারছে না। অথচ সাংবিধানিকভাবে সরকারি অর্থের অডিট সিএজিকে দেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে কর ও শুল্ক সংক্রান্ত আইনে যাই উল্লেখ থাকুক, তা এই অধিকার খর্ব করতে পারে না। সূত্র জানায়, বিগত ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত গোপনীয় তথ্য ও বিল অব এন্ট্রিসহ নানা দলিল নিরীক্ষা দলের কাছে উপস্থাপনে দাপ্তরিক অসহযোগিতার কারণে আইসিডি কমলাপুরের কাস্টম হাউসে নিরীক্ষা করা হয়নি। সমপ্রতি কনটেইনার গায়েব সম্পর্কিত কেলেঙ্কারি সামনে আসায় আইসিডি কমলাপুরের অধীনে বিল অব এন্ট্রিসহ অন্যান্য বিল অব এন্ট্রি নিরীক্ষার লক্ষ্যে গত নভেম্বর মাসে একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। কিন্তু তিন দফা উদ্যোগেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস নিরীক্ষা দলকে তথ্য উপস্থাপনে অস্বীকৃতি জানায়। ওই লক্ষ্যে নিরীক্ষা কতৃর্পক্ষ থেকে চিঠি ইস্যু করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে আলোচনায় সমাধান না হলে কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কতৃর্পক্ষের সঙ্গে সমাধানের পরামর্শ দেয়া হয়। তাছাড়া কর সার্কেল ২৮৮ এর কর কমিশনার ১৪ এর সঙ্গেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। নিরীক্ষা দল মোংলা বন্দরে গেলে সেখানেও অসহযোগিতার সম্মুখীন হয়। তাছাড়া প্রকাশ্যে আসে বিভিন্ন সময়ে নিরীক্ষা কতৃর্পক্ষ ও এনবিআরের বিভিন্ন পর্যায়ের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিরোধ। সূত্র আরো জানায়, আয়কর আইন ২০২৩ এর ১৯৬ ধারায় উল্লেখ আছে, এই আইন বা বাংলাদেশ বলবৎ অন্য আইনে যাই থাকুক না কেন আয়কর কতৃর্পক্ষ, আপিল ট্রাইবুন্যাল ও সুপ্রিম কোর্ট ছাড়া অন্য কেউ কর নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। কাস্টমস আইন ২০২৩ এ উল্লেখ আছে, কাস্টমস দলিল কাস্টমস কতৃর্পক্ষ ও আদালত ব্যতীত অন্য কারো নিকট সরবরাহ দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুরূপ, মূসক আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, মূসক কর্মকর্তা ব্যতীত অন্য কেউ কর নির্ধারণ ও অডিট করতে পারবে না। কিন্তু আয়কর সংক্রান্ত সিএজির কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত এক রিটের জবাবে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ আদালত জানায়, সরকারি অর্থের সব আয় ও ব্যয়ের ওপর নিরীক্ষা করা যথার্থতা, আইনি বৈধতা ও প্রযোজ্যতা নিশ্চিত করতে সিএজিকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া ২০২৪ সালের ভ্যাট সংক্রান্ত এক মামলায় আপিল বিভাগ জানিয়েছে, শুল্ক এবং ভ্যাট পরিশোধ সত্ত্বেও আমদানিকারক এবং অন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের রেকর্ড পরীক্ষা করার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষা মহাপরিচালকের রয়েছে। একই রায়ে আরো বলা হয়েছে, যদি নিরীক্ষা বিভাগ মনে করে যে ভ্যাট এবং অন্যান্য শুল্ক নির্ধারণে অনিয়ম হয়েছে, তাহলে রাজস্ব বোর্ডকে ভ্যাট প্রদানকারী এবং সংশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক নথি নিরীক্ষা বিভাগকে সরবরাহ করবে। এদিকে নিরীক্ষা কতৃর্পক্ষের তথ্যানুযায়ী, এনবিআরের প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার পুঞ্জীভূত নিরীক্ষা আপত্তি অনিষ্পন্ন রয়েছে। সরকারি আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রস্তাবিত অডিট বিল পাস হওয়া আবশ্যক বলে আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com