এফএনএস এক্সক্লুসিভ: বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিগত সরকারের গৃহীত অপ্রয়োজনীয় বিপুলসংখ্যক প্রকল্প বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ৪০টি প্রকল্প বাতিল অথবা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেগুলো ধারাবাহিকভাবে বাতিলের পাশাপাশি স্থগিত রাখার প্রস্তাব করা হবে। তাছাড়া বাতিল অথবা স্থগিতের তালিকায় প্রকল্পের সংখ্যা আরো বাড়বে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ইতিপূর্বে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই নির্দেশের পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ওই ধরনের প্রকল্পের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত সরকারের সময় নেয়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো তিন দিক বিবেচনা করে বাতিল করা হচ্ছে। তার মধ্যে প্রকল্পটি কতোটা মানুষের প্রয়োজনে নেয়া হয়েছে, প্রকল্প থেকে রিটার্ন কেমন আসবে এবং প্রকল্পটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিনা। তবে শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া প্রকল্পগুলো বাতিল হবে। আসন্ন একনেক সভায় মোট ১৫টি প্রকল্প উপস্থাপন করা হবে। এর মধ্যে আটটি অনুমোদনের জন্য, ছয়টি প্রকল্প অবহিত করার জন্য এবং একটি প্রকল্প বাতিলের জন্য। সূত্র জানায়, বিগত সরকারের নেয়া প্রকল্পের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় ও মন্ত্রী—এমপিদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রকল্পই বেশি। ওসব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বর্তমান সরকার। বাতিল হতে যাচ্ছে মৌলভীবাজারে সাবেক পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের বন ধ্বংস করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক তৈরির প্রকল্প। তাছাড়া আরো কয়েকটি প্রকল্প বাতিলের বিষয় চূড়ান্ত হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি গত বছরের নভেম্বরে একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও লাঠিটিলা বনটি সংরক্ষিত হওয়ায় পরিবেশবাদীরা সেখানে সাফারি পার্ক স্থাপনের বিরোধিতা করেন। কিন্তু তাঁদের আপত্তি উপেক্ষা করে সাফারি পার্ক স্থাপনের জন্য নেয়া প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। পরিবেশবাদীদের দাবি ছিল, বনের মধ্যে এ ধরনের সাফারি পার্ক নির্মিত হলে তা প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য আত্মঘাতী হবে। গত বছর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ভেঙে পাহাড় ও গাছ কেটে তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী নিজের নির্বাচনী এলাকায় বন ধ্বংসের এমন উদ্যোগ নেয়া হয়। পরিবেশবাদীদের আপত্তি উপেক্ষা করে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় সরকার। তবে সরকার পরিবর্তনের পর পাল্টে যায় পরিস্থিতি। প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় বর্তমান সরকার। সেজন্য গঠন করা হয় চার সদস্যের একটি কমিটি। আর ওই কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লাঠিটিলায় সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন বাতিলের সুপারিশ করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অনুমোদিত প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় পরিকল্পনা কমিশন। তবে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হলেও তখন বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। শর্ত প্রতিপালন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করে পুনর্গঠন করে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পুনর্গঠিত ডিপিপি পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় উদ্যোগী মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি বাতিলের সুপারিশ করে। সে অনুযায়ী প্রকল্প বাতিলের পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং বাতিলের জন্য একনেক সভায় প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু ওই প্রকল্পই নয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া অলাভজনক ও অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিল করতে যাচ্ছে সরকার। সেগুলো বাতিলের পাশাপাশি অর্থায়ন স্থগিত অথবা ব্যয় কাটছাঁট করা হবে। সূত্র আরো জানায়, বাতিলের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে সুনামগঞ্জের সঙ্গে নেত্রকোনার সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে হাওরে উড়ালসড়ক নির্মাণ। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আগ্রহে নেয়া এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় তিন হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। স¤প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের এক সভায় প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, হাওরে উড়ালসড়ক নির্মিত হলে পরিবেশ ও জীববৈচিতে্র্যর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাছা[া ফরিদপুর টেপাখোলা পার্ক স্থাপন প্রকল্পটিও বাতিল হচ্ছে। সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন মন্ত্রী থাকার সময় নিজ নির্বাচনী এলাকায় পার্কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ২০১৮ সালে নেয়া প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ১৮০ কোটি টাকা। যদিও প্রকল্পটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। এর অর্থায়নও স্থগিত হচ্ছে। সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের নির্বাচনী এলাকার জন্য মেহেরপুরে মেরিটাইম ইনস্টিটিউট নির্মাণের প্রকল্পটি বাতিল হচ্ছে। তাছাড়া নেত্রকোনায় শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, যশোরে শেখ জহুরুল হক পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, খুলনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভো থিয়েটার এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের জন্য ছয়টি ছাদ খোলা ট্যুরিস্ট বাস সংগ্রহ প্রকল্প স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ওই প্রকল্পগুলোর মধ্যে যেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেগুলোর সময় না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাস্তবায়নে মেয়াদ থাকলেও কিছু প্রকল্প স্থগিত করা হচ্ছে। ঢাকার হেমায়েতপুর থেকে আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত মেট্রো রেলের সাউদার্ন রুট প্রকল্প (এমআরটি লাইন—৫) আপাতত বাদ রাখছে সরকার। এর বদলে সরকার গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রো রেল (লাইন—২) নির্মাণে জোর দিচ্ছে। এদিকে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রকল্পগুলো মাঝপথে বাতিল করা হচ্ছে। কারণ জনগণের প্রকৃত চাহিদা এবং বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতা মূল্যায়ন না করেই এসব প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।