এম এম নুর আলম \ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত পরিবারের শিশুরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অর্থ উপার্জনের তাগিদে বাবা-মায়ের সান্নিধ্য ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ছে। মানুষের বাড়িতে, দোকানপাটে ফাই ফরমায়েস খাটা থেকে শুরু করে অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও নিয়োজিত হচ্ছে। আর এই সুযোগে দেশের প্রচলিত আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় নানা ধরনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবসার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ঝালাই, স্প্রে-পেইন্টিং, অটোমোবাইল গ্যারেজ, প্লাস্টিক দ্রব্য তৈরির কারখানা। জাতিসংঘ কর্তৃক চিহ্নিত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে ঝালাই কারখানার কাজ অন্যতম। কারখানা মালিকদের অধিক মুনাফা লাভের আশায় সেখানে নামমাত্র বেতনে শিশুদের দিনরাত খাটানো। কখনো শুধু একবেলা খাবারের বিনিময়ে তাদের কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে। কারখানার পরিবেশ দূষণজনিত কারণে শিশুরা শ্বাসকষ্ট, শ্রবণবৈকল্যসহ নানা রকম রোগর শিকার হচ্ছে। এছাড়া কারখানা মালিকের নির্যাতন-নিপীড়ন তো রয়েছেই। বাংলাদেশের শিশু শ্রমিকের মধ্যে একটি বিশাল অংশ হচ্ছে মেয়েশিশু। দরিদ্র পরিবারের বেশিরভাগ মেয়েশিশুকে গৃহকর্মীর কাজে লাগানো হয়। সেখানে দুবেলা দুমুঠো খাবারের বিনিময়ে দিনরাত খেটে যেতে হয়। কখনো সামান্য খাবারটুকু থেকেও বঞ্চিত হতে হয় ওদের। এছাড়া নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন তো রয়েছেই। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্যই মূলত শিশুশ্রমের জন্য দায়ী। বাংলাদেশে শিশুশ্রম দিনদিন বেড়ে তা আজ আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে কারখানায়সহ প্রায় ৪৭ ধরনের কাজ করানো হয় শিশুদের দিয়ে।আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে ১৮ বছরের কম বয়সের শিশুদের দিয়ে এ ধরনের কাজ করানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুশ্রম প্রতিরোধে শিশুশ্রমকে শিশুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল মনে করে শিশুশ্রম প্রতিরোধে গৃহীত কার্যসূচিতে ২০১৬ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও দেশের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ও দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মনে যে শেকড় গজিয়েছে এর কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় তা বাস্তব রূপ নেয়নি। প্রতি বছর ১২ জুন ঘটা করে শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হলেও ২০২৩ সালের মধ্যে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে কিনা বলা মুশকিল। কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগদানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে কার্যকর এবং গৃহকর্মে নিয়োগ ও ভাঙ্গাড়ি খাতকেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। শিশুশ্রম প্রতিরোধ কার্যক্রমকে সফল করে তুলতে অবিলম্বে শিশুনীতি বাস্তবায়ন, আইএলও কনভেনশন ১৮২ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও ১৩৮ অনুসমর্থন করাসহ পথশিশু, ছিন্নমূল শিশু ও শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও কল্যাণে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কলকারখানার বিকাশ, উৎপাদন বৃদ্ধি ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের প্রসার ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়। আবার দারিদ্র্য নির্মূল করা ছাড়া শিশুশ্রমও বন্ধ করা যাবে না। শিশুশ্রম যেমন শিশুর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে, তেমনি সৃষ্টি করছে নানাবিধ সামাজিক সমস্যার। এর ফলে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে সামাজিক সুস্থ বিকাশের ধারা। শিক্ষাবঞ্চিত নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন শিশুদের স্বল্পমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণদানের পর তাদের ঝুঁকিমুক্ত কাজের সংস্থানের জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এলে শিশুশ্রমের প্রবণতা কমে যাবে। অধিকার বঞ্চিত শিশুদের পুনর্বাসনের মানবিক দায়িত্ব সমাজের বিত্তবানদের ও রাষ্ট্রের। শিশুশ্রম বন্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলে বাস্তবায়নের পথও উন্মুক্ত হবে। শিশুদের লেখাপড়া, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য অনুক‚ল পরিবেশ গড়ে তোলা ছাড়া শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবে না। এ লক্ষ্যে শিশুশ্রম এর কুফল সম্বন্ধে শিশুর অভিভাবকসহ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে তোলাসহ শিশুদের শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধের স্থায়ী সমাধান বেরিয়ে আসুক।