এফএনএস : বিদ্যুতে আইপিপি নির্ভরতায় লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। বরং প্রতি বছরই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির দেনা বেড়েই চলেছে। ভর্তুকি দিয়েও তা কমানো যাচ্ছে না। এজন্য অনেকাংশেই বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো (আইপিপি) থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে তা কম দামে বিক্রি করাই দায়ি। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পায়রা ও রামপালের মতো যৌথ বিনিয়োগভিত্তিক বড় প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয়ও। ফলে আইপিপি ও বড় প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদই বিপিডিবির মোট ব্যয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ চলে যাচ্ছে। অথচ বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ সক্ষমতার প্রায় অর্ধেকই গড়ে অব্যবহৃত থাকছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিপিডিবি আইপিপি ও কুইক রেন্টাল থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনছে। আর ওই কারণেই সংস্থাটির দেনার বোঝাও প্রতিনিয়ত ভারী হয়ে উঠছে। চলতি অর্থবছরের ব্যয় নির্বাহের জন্য বিপিডিবির প্রয়োজন হবে ৫৯ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। তার মধ্যে আইপিপি এবং পায়রা ও রামপাল থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪ হাজার ৯ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৭৪ শতাংশেরও বেশি। তার সঙ্গে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ব্যয় যুক্ত হলে তা দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ৯১৬ কোটি টাকায়, যা চলতি অর্থবছরের মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৭৭ শতাংশ। যদিও বৈশ্বিক জ¦ালানির বাজার দরে অস্থিতিশীলতার কারণে এখন বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রেও উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। ফলে বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও (নিট) এবার গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটির বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়াবে ১১ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে বিপিডিবির সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব চাহিদা বেড়েছে। তার মধ্যে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ সবচেয়ে বেশি ব্যয় বেড়েছে। গত অর্থবছরের তুলনায় এবার শুধু আইপিপি ও এসআইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ সংস্থাটির ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে প্রায় ১০ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে আইপিপি ও এসআইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। তাছাড়া বিপিডিবির রাজস্ব ব্যয়ের বড় অংশজুড়ে রয়েছে বাস্তবায়নাধীন কয়লাভিত্তিক দুটি বৃহৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়। তার একটি হলো পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ও রামপালে নির্মাণাধীন একই সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। দুটি প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ চলতি অর্থবছরে বিপিডিবির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। যদিও ওই দুটি প্রকল্পের একটি উৎপাদনে এলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কবে নাগাদ উৎপাদনে আসবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তাছাড়া রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সংস্থাটির ব্যয় হবে ১ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। আর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ ব্যয় হবে ৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। সূত্র আরো জানায়, দেশে সরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা বেশি থাকলেও বিপিডিবি সেগুলোকে বসিয়ে রেখে আইপিপি থেকে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কিনছে। প্রতি বছরই ওই বিদ্যুৎ ক্রয় বাড়ছে। ফলে সংস্থাটির বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ বিপুল অংকের অর্থ পরিশোধ করছে হচ্ছে। যদিও সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই এখন বসিয়ে রাখা হচ্ছে। চলতি বছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবদান হবে ৫৬ শতাংশ। বাকি ৪৪ শতাংশ জ¦ালানি তেল, কয়লা ও সৌরবিদ্যুৎভিত্তিক। মূলত দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোই সবচেয়ে বড় ভ‚মিকা রাখে। বিপিডিবির সাড়ে ৭ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট ফ্যাক্টর মাত্র ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে আইপিপি ও এসআইপিপিগুলোর প্লান্ট ফাক্টর যথাক্রমে ৬৩ ও ৭৪ শতাংশ। তাছাড়া বিপিডিবির বসিয়ে রাখা নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পেছনেও ব্যয় এখন বাড়ছে। কারণ দীর্ঘসময় বসিয়ে রাখলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশের ত্র“টি-বিচ্যুতি দেখা দিতে পারে। তাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে ব্যয়ের অংকও বেড়ে যায়, যা বিপিডিবির রাজস্ব চাহিদার সঙ্গে যুক্ত হয়। এদিকে বিপিডিবি সংশ্লিষ্টদের মতে, বিপিডিবির রাজস্ব চাহিদা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ বিশ্বব্যাপী জ¦ালানি মূল্যবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়া। বিশেষ করে এলএনজির মূল্য অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমিয়ে জ¦ালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বেড়েছে। গ্যাস অপেক্ষা জ¦ালানি তেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেশি। তাতে বিপিডিবির ব্যয়ও বেড়েছে বেশি। চলতি বছর বিপিডিবির রাজস্ব চাহিদা প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় কমানো, সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে নীতি গ্রহণ এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তির সংস্কার করা গেলে বিপিডিবির ভর্তুকির প্রয়োজন হতো না। বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় করা গেলে বছরে বিপিডিবির ৩ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিরও প্রয়োজন হবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। ওই অর্থ সরকারের পকেট থেকে দিতে হয়। অথচ সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর ৬ শতাংশ নতুন কর আরোপ, জ¦ালানি তেলে শুল্ক-কর অব্যাহতি ও কয়লায় নতুন করে ৫ শতাংশ ব্যয় না বাড়ালে নতুন করে ঘাটতি বাড়তো না। সার্বিক বিষয়ে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন জানান, বিদ্যুৎ খাতের রাজস্ব ব্যয়ে সরকার গুরুত্বারোপ করেছে। বিশেষ করে ব্যয় কমাতে এরইমধ্যে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্টের’ ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ক্রয়ের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে না। একই সঙ্গে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে সেগুলো নবায়ন না করার নীতিতে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। ওসব ব্যয় কমাতে পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় কমে আসবে।