এফএনএস : অসাধু সিন্ডিকেটের দাপটে আকাশপথের টিকিট এখন যাত্রীদের জন্য সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশচুম্বি টিকিটের দাম এবং টিকিট সঙ্কট যাত্রীদের ভয়াবহ সঙ্কটে ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক প্রবাসী শ্রমিকই নিরুপায় হয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে বিমানের টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছে। মূলত কিছু এয়ারলাইনস টিকিট বিক্রি ও বিপণন নীতিতে নাম ছাড়া টিকিট বুকিং বা ব্লক রাখার কারণেই আকাশপথে টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে রিজারভেশন সিস্টেমে ফ্লাইটে কোনো সিট খালি থাকলেও ব্লক করে রাখার কারণে ওসব টিকিটও বিক্রি হয়েছে বলে দেখানো হচ্ছে। তারপর এই টিকিট সিন্ডিকেট নিজেদের ইচ্ছেমতো তিন-চার গুণ বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা লুটছে অসাধু চক্র। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) এবং ভুক্তভোগীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ট্রাভেল এজেন্টদের কাছে আগামী মার্চ পর্যন্ত সৌদি আরবের কোনো টিকিট নেই। তবে কালোবাজারে টিকিট আছে। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলোতে পর্যাপ্ত ফ্লাইট না থাকায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এয়ারলাইনসগুলো নিজেদের মতো করে টিকিট ব্লকের জমজমাট বাণিজ্য করছে। রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনসও ওই সিন্ডিকেটে ঢুকে পড়েছে। বর্তমানে বিমান ভাড়া অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। আর তাতে বিপাকে পড়েছে প্রবাসী শ্রমিক, সাধারণ যাত্রী, ওমরাহগামী যাত্রী, রিক্রুটিং এজেন্সি, ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেটররা। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধান প্রতিবেদনে মধ্যপ্রাচ্যগামী বিমানের টিকিটের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও টিকিট ব্লকিংয়ের পেছনে একটি অসাধু সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা তুলে ধরা হয়েছে। সূত্র জানায়, আকাশপথে অতিরিক্ত ভাড়ার দৌরাত্ম্য গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু হলেও জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারিতে তা সব রেকর্ড ভেঙেছে। সাড়ে ৩ মাস আগেও যেখানে সৌদি আরবের জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম, মদিনা, আরব আমিরাতের দুবাই, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ অন্যান্য রুটে ইকোনমি ক্লাসের একমুখী ভাড়া সর্বোচ্চ ২৫-৩০ হাজার টাকার মধ্যে ছিল। এখন ওই টিকিটের মূল্য ৩/৪ গুণ বেড়ে লাখ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ পাশের দেশে ওসব রুটে টিকিটের মূল্য ৪০ হাজার টাকারও কম। তাছাড়া একই গন্তব্যের ফিরতি পথের দূরত্ব একই হলেও টিকিটের দাম ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা মাত্র। টিকিট সঙ্কট সৃষ্টি করে ভাড়ার নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য কতিপয় প্রভাবশালী ট্রাভেল এজেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। মূলত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতা এবং চাহিদা ও জোগান সম্পর্কে কোনো তথ্য বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ চাহিদা নিরূপণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এয়ারলাইনসগুলো বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অনুমতি নিয়ে পরিচালিত হয়। বেবিচক সব এয়ারলাইনসের বিভিন্ন রুটের ভাড়া অনুমোদন করে থাকে। কিন্তু এখন কেন বেবিচক অস্বাভাবিক ভাড়া নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিচ্ছে না এবং ফ্লাইট সক্ষমতা ও অতিরিক্ত ফ্লাইটের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না তা এক বড় রহস্য। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও তার ফলে জনগণের ক্ষতির দায় বেবিচক কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। এদিকে উড়োজাহাজ সংস্থা সংশ্লিষ্টদের মতে, বিভিন্ন কারণে আকাশপথে ভাড়া বেড়েছে। করোনা মহামারির পরবর্তী সময়ে উড়োজাহাজ চলাচল প্রায় স্বাভাবিক হতেই টিকিটের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি ট্রানজিট সুবিধার সঙ্কট, বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার পুরোদমে চলছে কর্মী রপ্তানি, ছুটিতে আসা প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থলে ফেরার তাড়া, ওমরাহ হজের অনুমতি, জেট ফুয়েলের মূল্যবৃদ্ধি এবং এয়ারলাইনসগুলোর করোনাকালীন স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে টিকিটের দাম বেড়েছে। আর টিকিটের দাম তিন-চার গুণ বৃদ্ধি পেছনে মুনাফার বিষয়টিও জড়িত। মধ্যপ্রাচ্যের যাত্রীদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বহন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। বাদবাকি যাত্রীরা দেশি-বিদেশি অন্যান্য এয়ারলাইনসে যাতায়াত করে। সাম্প্রতিককালে প্রবাসী কর্মীদের চাপ বাড়লেও বিমান কর্তৃপক্ষ মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিমানের ভাড়া কয়েক গুণ বেশি। বর্তমানে ঢাকা থেকে ৬ ঘণ্টার জার্নি রিয়াদে যেতে ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে। অথচ ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্ক ২৩ ঘণ্টার জার্নিতে ভাড়া লাগছে মাত্র ৬৫ হাজার টাকা। এখন ঢাকা থেকে দুবাইয়ে ওয়ানওয়ে সৌদি এয়ারলাইনসের ভাড়া ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা, জাজিরা এয়ারলাইনসের ভাড়া ৮৫ হাজার টাকা। আর ওই গন্তব্যে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসের ভাড়া ৯৩ হাজার টাকা, এমিরেটস ও ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ৯৮ হাজার ৮০০ টাকা। ওমানের মাসকাটে আগে একমুখী ভাড়া ছিল ৩৫ হাজার, বর্তমানে সব এয়ারলাইনস ৭২ হাজার টাকা নিচ্ছে। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী জানান, সিন্ডিকেট শনাক্ত করা গেলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকার ওই ব্যাপারে কাজ করছে।