শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:৫৮ অপরাহ্ন

আজ কপিলমুনি মুক্ত দিবস

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২২

কপিলমুনি প্রতিনিধি \ আজ ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে ১৫৫ জন রাজাকারকে গনআদালতের রায়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। অবসান ঘটে পাকিস্তানী হানাদার রাজাকারদের নির্মম অত্যাচার নিপীড়ন-নির্যাতন সহ অনৈতিক কর্মকান্ডের লোমহর্ষক ঘটনার। প্রসংগত, কপিলমুনির স্থপতি স্বর্গীয় রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু মহোদয়ের বাসভবন রাজাকাররা তাদের সুরক্ষিত দূর্গ হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ৭১ সালের মুক্তি যুদ্ধের সময় বাড়িটি দীর্ঘ নয় মাস ব্যবহার করেছিল পাকিস্তানী দোসর রাজাকাররা। সেখানে খুন, গুম, ধর্ষনসহ অনেক অনৈতিক ঘটনার অবতারণা করা হয়। আর সেসব দিনের স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে দ্বিতল বিশিষ্ট বাড়িটি। বাড়ির অভ্যন্তরে এমন কোন অপরাধ নেই যা তারা করেনি। কথিত আছে কপিলমুনিসহ পাশ্ববর্তী এলাকা থেকে সংখ্যালঘু ও রাজাকারদের সাথে বৈরি সম্পর্কের লোকদের অর্থাৎ মুক্তিকামী মানুষদেরকে ধরে এনে কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে নির্মম ভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাতো পাক হানাদাররা। প্রতিদিন এই বধ্যভূমিতে মানুষের লাশ কুকুর, কাক, শকুনে ছিড়ে ছিড়ে খাওয়ার দৃশ্য ছিল খুবই লোমহর্ষক ও মর্মপীড়াদায়ক। জানাগেছে, ১৯৭১ সালের এই দিনে ৪৮ ঘন্টা রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৫৫ রাজাকারের আত্মসর্মাপনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ খুলনার সর্ব বৃহৎ শত্রু ঘাটির পতন ঘটে। ঐ দিন উপস্থিত হাজার হাজার জনতার রায়ে আত্মসমর্পণকৃতদের মধ্যে ১৫১ জন রাজাকারকে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে রায় কার্যকর করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর দোসররা সারা দেশব্যাপী সাধারণ নিরীহ মানুষের উপর অবর্নণীয় অত্যাচার ও নির্যাতন চালাতে থাকে। আর এ অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মত জেলার পাইকগাছার সর্বত্র প্রতিরোধ দূর্গ গড়ে ওঠে। এ সময় পাক দোসররা বিশাল অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘাঁটি করে ঐতিহ্যবাহী কপিলমুনিতে। অত্যাচারি বহু পরিবার সে সময় বিদেশে পাড়ি জমায়। কপিলমুনির পরিত্যাক্ত স্বর্গীয় রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটি পাকিস্তানী দোসররা ঘাঁটি হিসাবে বেছে নেয় এবং এলাকায় নিযার্তনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। এ সময় তারা এলাকায় নিরীহ মানুষেদের ধরে ক্যাম্পে এনে শরীরের বিভিন্ন অংশে কেটে লবন দিত। এমনকি নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ নদীতে ফেলে দিত। এলাকার হিন্দুদের বসবাস বেশী থাকায় এখানকার হিন্দুদের উপর চলত অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন। তাদের ধন সম্পদ লুট, এমনকি তাদেরকে জোর করে হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মেও দীক্ষিত করা হত। বাধ্য করা হতো মুসলমান ধর্ম গ্রহনে। এ সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাইকগাছার রাড়ুলি, বাঁকা, বোয়ালিয়া ও গড়ুইখালি মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প গড়ে তোলে। খুলনাঞ্চলের মধ্যে কপিলমুনির শত্রু ঘাঁটি ছিল সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। সাড়ে ৩’শর বেশি পাকসেনা ও তাদের দোসররা এখানে অবস্থান নেয়। ছাদের উপরে সব সময় তাক করা থাকত ভারী অস্ত্র, কামান ও মেশিনগান। ১৯৭১ সালের ১১ই নভেম্বর ক্যাপ্টেন আরেফিনের নের্তৃত্বে একদল মুক্তি বাহিনী প্রথমে কপিলমুনি রাজাকারদের ঘাঁটিতে আঘাত করে। কিন্তু সুরক্ষিত দুর্গ আর রাজাকারদের শক্ত অবস্থানের কারনে সেই যুদ্ধে কোন সফলতা পায়নি। পরবর্তিতে পুনরায় পরিকল্পনা করে দক্ষিন খুলনার বিভিন্ন এলাকার কমান্ডিং অফিসাররা উপজেলার রাড়ু–লীর বাঁকা ক্যাম্পে এসে। সকলে একত্রিত হন এবং কপিলমুনিকে রাজাকার মুক্ত করতে পরিকল্পনা গ্রহন করেন। ঐ সময় পরিকল্পনায় অংশ গ্রহন করেন নৌ’কমান্ডার গাজী রহমত উল­াহ দাদু, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, স.ম বাবর আলী, গাজী রফিক, ইউনুস আলী ইনু, শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু, মোড়ল আব্দুস সালাম, আবুল কালাম আজাদ সহ অনেকে কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযোদ্ধারা ৫ টি ভাগে বিভক্ত হয়ে অবশেষে ৭ ডিসেম্বর রাতে চারিদিক থেকে কপিলমুনি শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ করে। দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে ৯ ডিসেম্বর বেলা ১১ টার দিকে অস্ত্র ফেলে সাদা পতাকা উড়িয়ে ১৫৫ জন রাজাকার পাকিস্তানি দোসররা আত্মসমার্পন করে। সাথে সাথে পতন ঘটে খুলনাঞ্চলের বৃহত্তর শত্রু ঘাঁটির। এই যুদ্ধে খুলনার আইসগাতির আনোয়ার ও সাতক্ষীরার আশাশুনির গলডাঙ্গা গ্রামের গাজী আনসার আলী নামে দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শত্রুদের বন্দি করে নিয়ে আসা হয় কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির ঐতিহাসিক ময়দানে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকার হাজার হাজার জনতার ঢল নামে ময়দানে। জনগনের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাৎক্ষণিক যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজাকারদের প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদন্ড দিয়ে জনতার রায় কার্যকর করা হয়। শেষ হয় যুদ্ধ। হানাদার মুক্ত হয় কপিলমুনি।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com