এফএনএস: মাতৃভাষা আন্দোলনের ওপর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা আর আলতাফ মাহমুদের সুর করা কালজয়ী এ গানটি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি-আমি কি ভুলিতে পারি’- কোটি কোটি বাঙালীর হৃদয়ে বেদনা জাগায়। অমর এ গানটি কোটি কোটি বাঙালীর মনের বিরাট অংশজুড়ে জায়গা নিয়ে আছে। গানটি শুনলেই কোটি কোটি মানুষের বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে সেদিনের সেই বর্বর পাকিস্তানীদের অত্যাচার আর নির্যাতনের ভয়াবহতার কথা। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে ভাইয়ের রক্ত, ছেলেহারা মায়ের অশ্র“সিক্ত চোখ। যুগ যুগ ধরে বাঙালীর হৃদয়ে ভাষা আন্দোলন আর একুশের চেতনাকে জাগ্রত করে রেখেছে একুশের গান ও ভাষার এ গান। মহান ২১শে ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে নিজের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছিলেন। যা ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। যাঁদের জন্য আজ পুরো পৃথিবীতে ২১শে ফেব্র“য়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সেদিন ভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে নেমে যায় ছাত্র-জনতা। দৃপ্ত শ্লোগানে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহামেদ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ হলেন তিনি, একুশের প্রথম শহীদ এ বীর অমর হয়ে থাকবেন ভাষার ইতিহাসে। নূরুল আমিনের ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে নেমে দৃপ্ত শ্লোগানে বরকতও ছিলেন মিছিলের সাগরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র বরকত শহীদ হন। মিছিলে মিছিলে উত্তাল সারাদেশ। উত্তপ্ত ঢাকার নওয়াবপুর রোডও। ৮ বছরের শিশু অহিউলাহ তখন তৃতিয় শ্রেণীর ছাত্র। তিনিও শরিক হয়েছিলেন মায়ের ভাষায় দাবিতে, পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন তিনি। পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেন হাইকোর্টের হিসাবরক্ষণ শাখার কেরানি শফিউর রহমান। বিদ্রোহের হাওয়া তাঁকেও নিয়ে গেল মিছিলে। তিনিও শ্লোগান দিলেন ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ উত্তাল শ্লোগানে রাজপথ কেঁপে ওঠে। এমন একসময় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর হুকুমে তাঁবেদার পাকি পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়। হাঁটু আর কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলেন আব্দুল জব্বার। মাতৃভাষার দাবিতে বাঙালী যখন এক জোট, তখন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক তরুণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দিয়ে বেরিয়ে এলো রাজপথে। মাতৃভাষার দাবি নিয়ে পাকিস্তান গণপরিষদ ঘেরাও করতে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা মিছিলে অংশ নেয়। কিন্তু মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা থেকে শুরু হলেও বেশি দূর এগোতে পারেনি। এর পরই পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালায়। শহীদ হন রফিক, শফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকেই। তখনই রচিত হলো মাতৃভাষার অমর কাব্যগাথা। শুরুটা ’৪৮ থেকে শেষ হয় ’৫২ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারি। এ দীর্ঘ সময় ভাষার লড়াইয়ে সব সময়ে সবার আগে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহŸায়ক ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্র“য়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণার প্রতিবাদে সারাদেশে পালিত হয় হরতাল ও ছাত্রসভা। নেতৃত্ব দিলেন ছাত্রনেতা গাজীউল হক। স্কুল-কলেজ ঘুরে ছাত্রদের উদ্দীপ্ত করেন তিনি, ২০ তারিখ রাতে সব হলের ছাত্রদের সংগঠিত করলেন। সভাপতিত্ব করেন একুশের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ডাকা হরতাল কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে গ্রেফতার হন তিনি। ১৯৫২-এর জানুয়ারিতে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়ক গোলাম মাহবুব ২১শে ফেব্র“য়ারি ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত জানান। শুরু হয় একুশের প্রেক্ষাপট। ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও একুশের দুপুরে ১৪৪ ধারা ভাঙলেন। ছাত্রীদের মধ্যে নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী শাফিয়া খাতুন। রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতে প্রতিবাদে পার্লামেন্ট বয়কট করেন আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। নূরুল আমিনের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ছাত্র- জনতার পাশে মিছিলে যোগ দেন। সেদিন গণপরিষদের অধিবেশন বয়কট করলেন ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ‘৪৮-এর ২৩ ফেব্র“য়ারি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে তিনিই প্রথম দাবি জানান রাষ্ট্রভাষা বাংলার।