এফএনএস: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার তৎপরতার কারণে এবারের ঈদযাত্রা খানিকটা স্বস্তিদায়ক হলেও সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটি বলছে, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ২৬ এপ্রিল থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ১০ মে পর্যন্ত ১৫ দিনে ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত ও ৮৪৪ জন আহত হয়েছেন। ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরে যাতায়াতের সঙ্গে তুলনা করলে এবার ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ১৪.৫১ শতাংশ, নিহত ২২.৩৫ শতাংশ ও আহত ২৬.৩০ শতাংশ বেড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন’ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিদায়ী পবিত্র ঈদুল ফিতরে যাতায়াতে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত ৮৪৪ জন আহত হয়েছেন।সড়ক, রেল ও নৌপথে সম্মিলিতভাবে ৪০২টি দুর্ঘটনায় ৪৪৩ জন নিহত ও ৮৩৮ জন আহত হয়েছেন। সংগঠনটি ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানির বিষয়টি দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৬৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৫ জন নিহত ও ১১০ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৪.০৮ শতাংশ, নিহতের ৩৪.৮৫ শতাংশ ও আহতের ১৩.০৩ শতাংশ প্রায়। এ সময় সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ২০৯ জন চালক, ২৪ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮৮ জন পথচারী, ৬২ জন নারী, ৩৫ জন শিশু, ৩৩ শিক্ষার্থী, দুইজন সাংবাদিক, আটজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ১২ জন শিক্ষক, ছয়জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একজন চিকিৎসকের পরিচয় মিলেছে। প্রতিবেদনে সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে বলা হয়, মোট যানবাহনের ৩৮.৭৫ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৫.৪৯ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি, ৮.৪৫ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ, ৫.২৩ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ৮.৮৫ শতাংশ অটোরিকশা, ৫.৪৩ শতাংশ ব্যাটারি রিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল, ও ১৭.৯০ শতাংশ বাস এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল। সংঘটিত দুর্ঘটনার ২০.৯৬ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৪২.৪৭ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা, ১৫.৩২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ১৯.৮৯ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে, ১.০৭ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষ ও ০.২৬ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে। আরও বলা হয়, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৩.৮৭ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৪.৩৫ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ১৩.৪৪ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪.৮৩ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ২.৪১ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে সংঘটিত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সদস্যরা বহুল প্রচারিত ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক ও অনলাইন দৈনিক এ প্রকাশিত সংবাদ মনিটরিং করে এ প্রতিবেদন তৈরি করে। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার এই চিত্রকে একটি প্রতীকী চিত্র বলা চলে। প্রকৃতপক্ষে দেশে বর্তমানে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক ক্যান্সারের মতো বেড়ে যাওয়ার কারণে পঙ্গু হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ রোগী ভর্তি হলেও ঈদের সময়ে ২০০ থেকে ২৫০ জন হারে প্রতিদিন রোগী ভর্তি হয়েছে। যার ৬০ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২৫ শতাংশ ইজিবাইক দুর্ঘটনায় শিকার। এছাড়াও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। দেশের বিভাগীয় হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ১০০ সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। জেলা সদর হাসপাতালে ও আক্রান্ত রোগীর যে ধরনের ভয়াবহ চিত্র দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের চিত্র সংবাদপত্রে উঠে আসে না বলেই আমরাও এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরতে পারি না। তিনি আরও বলেন, সড়ক, রেল ও নৌপথের উন্নয়নে সরকার কয়েক লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প প্রায় একযুগ ধরে বাস্তবায়ন করে আসছে। মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের আমদানি বন্ধের পাশাপাশি গণপরিবহনকে বিকশিত করার দাবি জানাই। সংবাদ সম্মেলনে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, প্রতিবছর পাঁচ লাখ মোটরসাইকেল বিপণন করে কোম্পানিগুলোর পাঁচ হাজার কোটি টাকা আয় হলেও দুর্ঘটনায় ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বেশি সিসির মোটরসাইকেল অনুমোদন দেওয়ায় বিআরটিএর সমালোচনা করে তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে। আমরা এ সিদ্ধান্ত পরিবতনের আহŸান জানাই। মহাসড়কে ঈদযাত্রার বহরে মোটরসাইকেলের ব্যাপক ব্যবহার, ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালানো, মহাসড়কের নির্মাণত্র“টি, যানবাহনের রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা, উল্টোপথে যানবাহন চালানোসহ সড়ক দুর্ঘটনার বেশ কয়েকটি কারণ বের করে তা রোধের জন্য ৯টি সুপারিশ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সুপারিশসমূহ: ১. জরুরি ভিত্তিতে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা ২. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা ৩. দক্ষচালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ক্রটি সারানোর উদ্যোগ গ্রহণ ৪. ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা ৫. সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা ৬. সড়কে রোডসাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা ৭. সড়ক পরিবহন আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা, ট্রাফিক আইনের অপপ্রয়োগ রোধ করা ৮. গণপরিবহন বিকশিত করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ৯. মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোডসেফটি অডিট করা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বুয়েট দুর্ঘটনা কেন্দ্রের পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির যুগ্ম মহাসচিব এম মনিরুল হকসহ সংগঠনটির নেতারা।