স্টাফ রিপোর্টার \ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ২৭ শতাংশ মানুষ বর্তমানে বন্যার ঝুঁকিতে আছে। চলতি শতাব্দীতে উপকূলীয় বন্যার এই ঝুঁকি বেড়ে ৩৫ শতাংশ হতে পারে। বর্তমানে বন্যায় উপকূলীয় এলাকায় বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশ: এনহেন্সিং কোস্টাল রিজিলিয়ান্স ইন চেঞ্জিং ক্লাইমেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা ঝুঁকির দিক নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বদ্ধির কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ চলতি শতাব্দীতে দ্বিগুণ হতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের উপকূলীয় এলাকার জনসংখ্যা বেড়ে ৬ কোটি ১০ লাখে দাঁড়াবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের উপকূলের ৪ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যেতে পারে। এতে দেশের উপকূলীয় এলাকায় মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি আরও বাড়তে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার যে অভিযোজন পরিকল্পনা করেছে, তা বাস্তবায়নে ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিবছর ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার দরকার হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে গত ২০ বছরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারের গড়ে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৪৯১ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা অঞ্চলের শরীয়তপুরে এই ক্ষতির পরিমাণ গড়ে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৩০ টাকা। আর বরেন্দ্র অঞ্চলে গড়ে ৩৩ হাজার ৭৬৯ টাকা ক্ষতি হয়েছে। গবেষণা করে এমন ফলাফল উপস্থাপন করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি)। গবেষণায় সংস্থাটি আঞ্চলিক তিনটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) শরীয়তপুর এলাকায় শরীয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (এসডিএস), রাজশাহীতে মাসাউস এবং সাতক্ষীরায় বাদাবন সংঘের সহায়তা নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ওই তিন অঞ্চলের ২০০ করে ৬০০টি পরিবারের ওপর গবেষণাটি হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। সিপিআরডির নির্বাহী প্রধান মো. শামসুদ্দোহা এই ফলাফল তুলে ধরেন। সিপিআরডির নির্বাহী প্রধান শামসুদ্দোহা বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে আর্থিক ক্ষতির অন্যতম কারণ কৃষিজমি ও বসতভিটা হারানো। এর কারণে ৫০ দশমিক ৩ ভাগ পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া বসতবাড়ির ক্ষয়ক্ষতির কারণে ২৯ দশমিক ৭ ভাগ পরিবার, গৃহপালিত পশুপাখির কারণে ৮ দশমিক ৪ ভাগ পরিবার, গৃহস্থালি সামগ্রীর ক্ষয়ক্ষতির কারণে ৫ দশমিক ৮ ভাগ এবং মাছ ধরার সরঞ্জাম, গাছপালা, রান্নাঘর ও শৌচাগারের ক্ষতির কারণে ৩ দশমিক ৪ ভাগ। ওই এলাকার শতভাগ মানুষ স্বাস্থ্য সংকটে ভোগার পাশাপাশি প্রাণহানি বেড়েছে ২ দশমিক ৫ ভাগ পরিবারে। আর ৩২ দশমিক ৫ ভাগ পরিবারের শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে, ১৪ দশমিক ৫ ভাগ পরিবারে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ৯৯ ভাগ পরিবারে রোগব্যাধি বেড়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের ৯৩ ভাগ পরিবার খাওয়ার পানির সংকটে ভুগছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। অতিরিক্ত গরমের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৩৮ দশমিক ৫ ভাগ মানুষের শ্রমঘণ্টা কমেছে। বিভিন্ন মেয়াদে কর্মহীন হয়েছে ৪৮ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ। আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ৯৯ দশমিক ৫ ভাগ পরিবারে রোগব্যাধি বেড়েছে বলে গবেষণায় পাওয়া গেছে। গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন শেষে সিপিআরডির নির্বাহী প্রধান শামসুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ভুক্তভোগীদের খাদ্য, পানি, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা প্রাপ্তির মৌলিক অধিকার এবং মানসম্মত জীবনযাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশে সফরে আসা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়ান ফ্রাই জাতিসংঘে এ বিষয়টি উপস্থাপন করবেন বলেও তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারী নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, গণমাধ্যমে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের মুখ থেকে তাদের বঞ্চনা এবং অধিকার হরণের গল্প শোনা যায়। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে বিশ্বের ৪৮টি বদ্বীপ এলাকার জলবায়ু ঝুঁকির একটি তুলনা টানা হয়েছে। এতে দেখা যায়, উপকূলীয় বন্যার ঝুঁকিতে থাকা বদ্বীপগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এই উপকূলীয় এলাকায় ১৩৭টি পোল্ডার অবকাঠামোগত ভাবে ও সুন্দরবন প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়াল হিসেবে ভূমিকা রাখছে। সুন্দরবন সহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ৪০০ প্রজাতির মৎস্যজাতীয় প্রাণী, ৫৩ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৩০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। বেঙ্গল টাইগার, কুমির, চিত্রা হরিণসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী এখানে আছে। শুধু সুন্দরবনেই বিশ্বজুড়ে বিপন্ন ১৭ প্রজাতির প্রাণী বাস করে। প্রতিবেদনটির সহ-রচয়িতা স্বর্ণা কাজী। তিনি বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘উচ্চ বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে আমরা অতীত থেকে শিখতে পারি। উদ্ভাবনী সমাধানগুলো খুঁজে পেতে পারি।’ এদিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার খোলপেটুয়া নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে ধস নেমেছে। মঙ্গলবার রাতে উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের বিড়াল²ী এলাকার বাঁধে ধস নামার পর এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। নিম্নচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টির কারণে জেলার উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন বাঁধে ধস, ফাটল ও বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। এ অবস্থায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদুল হক বলেন, খোলপেটুয়া নদীর বিড়াল²ী এলাকায় হঠাৎ ৭০ থেকে ৮০ ফুট জায়গায় ধস নেমেছে। ইতিমধ্যে তাঁরা এলাকা পরিদর্শন করে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। ধসে যাওয়া স্থানে বালু ফেলা হচ্ছে। পাউবো-২ সাতক্ষীরা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, পাউবো-২-এর আওতায় বাঁধের ৪০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের ৭-৮টি জায়গা বেশি খারাপ হয়ে গেছে। ওই সব জায়গায় কাজ চলমান।