জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে ॥ হারানো কার্ড উত্তোলন, মৃত ভোটারের নাম কর্তন এবং জাতীয় ভোটার পরিচয়পত্রে থাকা ভুল সংশোধনে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নামে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সংকুচিত করা হয়েছে। আগে এনআইডি সংক্রান্ত কাজে সচিবের এখতিয়ার না থাকলেও নতুন করে তাকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত করা হয়েছে। এনআইডি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে ডিজির নেয়া বাতিল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আপীল কর্তৃপক্ষ এখন আইন করে নির্বাচন কমিশন সচিবকে করা হয়েছে। আগে ছিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অপর চার নির্বাচন কমিশনার। এখন শুধু সচিবের সিদ্ধান্তকে রিভিশন করতে পারবেন সাংবিধানিক পদধারীরা। বলা যায়, ক্ষমতাপ্রাপ্তের দিক থেকে আপীল কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রে ‘ আউট কমিশনাররা, ইন সচিব’। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমলাতন্ত্রের যাতাকলে পিষ্ট মানুষ। তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতেই নতুন নতুন এই কানাকানুন জারি করা হচ্ছে। এতে ন্যায্য এনআইডি সংশোধনের ক্ষেত্রে আবেদনকারির ভোগান্ত্রিই বাড়বে বলে আশঙ্কা তাদের। কারণ এতো ধাপ পেরিয়ে একটি ভুল আইডি সংশোধন করতেই জীনদ্দেগী পার হয়ে যেতে পারে একজন নাগরিকের। আর কমিশনের সাবেকরা বলছেন, আপীল কর্তৃপক্ষ আইন দ্বারা সচিবকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ায় তাকে সফটলি ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সু-বিচার নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। এর পরও তার (সচিব) সিদ্ধান্ত রিভিশন করার ক্ষেত্রে কমিশন কতোটুকু বাতিল আবেদনটি টেকাতে পারবে তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। এনআইডি একটি উইং আর সচিবালয়ের মূখপাত্র সচিব দুটির কাজের ধরণ ভিন্ন। এতোদিন সচিবকে একাজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমলারা সব কিছুতেই থাকতে চায়, – এটাই সমস্যা। কথায় আছে, ‘বিচার মানি, তবে তালগাছটি আমার’। এছাড়া এনআইডি সংশোধনের ধরণে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন উইং থেকে সারাদেশের বিভাগওয়ারী ক্যাটাগরি নির্ধারণ করার পর আবেদনের ঠিকানা অনুযায়ী সংশোধনের কাজ চলতো। এমনকি ক্যাটাগরির ধরণ আগে চারটি থাকলেও তা বাড়িয়ে ৭টি করা হয়েছে। আগে ক, খ, গ ও ঘ এ চারটিতে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন ক ক্যাটাগরির সঙ্গে ক-১, খ ক্যাটাগরির সঙ্গে খ-১ এবং গ ক্যাটাগরির সঙ্গে গ-১ এবং ঘ ক্যাটাগরি স্বতন্ত্র রাখা হয়েছে। আগে ক্যাটাগরির কাজটি এনআইডিতে দায়িত্ব বণ্টনকারী কর্মকর্তারা করলেও নতুন এই সিদ্ধান্তের আলোকে সংশোধনের ধরণ অনুযায়ী আবেদনসমূহকে শ্রেণি বিভাজন সংক্রান্ত কার্যক্রম ইসির দশ অঞ্চলে কর্মরত ২০জন অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা সম্পাদিত করবেন। অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার এসংক্রান্ত কার্যক্রম জেলা ভিত্তিক বিভাজন অনুসারে পরিচালিত করবেন। এটা জেলা বিভাজন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা দ্বারা নির্ধারণ হবে। তবে হেড অফিসে সীমিত পরিসরে ক্যাটাগরি নির্ধারণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সহকারী পরিচালক/উপ-পরিচালককে (প্রতিকল্পসহ) দায়িত্ব প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নামে ক্ষমতাহীন হলেও এনআইডি উইংয়ের কর্মকর্তারাও। কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, এর আগে কোনো সচিব এনআইডি নিয়ে হস্তক্ষেপ করায় আগ্রহ দেখাতেন না। বর্তমান সচিব সবকিছুতেই নিজের কর্তৃত্ব জাহির করতে মরিয়া। তার একক সিদ্ধান্তে আরব-আমিরাতে জাতীয় ভোটার পরিচয়পত্র করতে বাধ্য হয়; কারণ তার ভাই সেখানে রাষ্ট্রদূত। এবার এনআইডি সংশোধনের ডিজির বাতিল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল কর্তৃপক্ষ সচিব।আইনের ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, মহাপরিচালকের সিদ্ধান্তে কোন ব্যক্তি সংক্ষুদ্ধ হলে এ সংক্রান্ত আদেশ অবহিত হওয়ার ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে আবেদনকারী বা ক্ষেত্রমতে, তাহার আইনানুগ প্রতিনিধি নির্ধারিত পদ্ধতিতে ওই আদেশের বিরুদ্ধে সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় বরাবর আবেদন করতে পারবেন। এটি আপীল প্রাপ্তির ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। বলা আছে, আপীল আবেদন বাতিলের বিরুদ্ধে দাখিল হওয়া আবেদনের ক্ষেত্রে কমিশন আপীল সিদ্ধান্ত ‘রিভিউ’ করতে পারবেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় পরিচয়পত্র ও সংরক্ষিত তথ্য উপাত্ত (সংশোধন, যাচাই এবং সরবরাহ) প্রবিধানমালা ২০১৪ এর্ব প্রবিধি ২(৫) এ সংজ্ঞায়িত এবং উক্ত প্রবিধিমালার প্রবিধি ৩ ও ৪ এ আবেদন দাখিল এবং আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ও তার দায়িত্ব নির্ধারণ করে গত ২১ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে এতোদিন আইনি কার্যকর করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন-ইসি। এ লক্ষ্যে সিষ্টেম উন্নতকরণের ত্রুটি খতিয়ে দেখার জন্য বিভিআরএস এবং এবিআইএস সিষ্টেম উইথ স্পেশাল এ্যামপেসিস অন এ্যানহেন্সমেন্ট অফ ডাটা প্রটেকশান এবং সিকিউরিটি শীর্ষক দুইদিনের (২৪ ও ২৫ মার্চ) কর্মশালার আয়োজন করা হয়। সেখানে বায়ো-এনরোল, আপলোডার, সিএমএস, সিটিজেন পোর্টাল ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে ওই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সেখানে বর্তমান সিষ্টেমে কোনো সমস্যা আছে কি না, সমস্যা উত্তরণের উপায়, সিস্টেমকে আরও ইউজার ফ্রেন্ডলি করা, নতুন কোনো ফিচার যুক্ত করা যায় কি না তা খতিয়ে দেখা এবং বর্তমান সিস্টেমের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে কর্মকর্তাদের সমৃদ্ধ করা। চলতি এপ্রিল মাস থেকে ক্যাটাগরিসহ এনআইডি সংশোধন সংক্রান্ত কার্যক্রম ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কাজ শুরু হবে। এনআইডি উইং থেকে এমনিই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব বিষয়ে মন্তব্য পেতে কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম এবং অতিরিক্ত সচিব ও এনআইডি ডিজির চলতি দায়িত্ব পালন করা অশোক কুমার দেবনাথকে ফোন করা হলে কলটি রিসিভ না করায় খবরে তাদের মতামত সংযোজন করা সম্ভব হয়নি। তবে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা বলেন, আপিল কর্তৃপক্ষ কমিশনের কাছে থাকলে ন্যায় বিচার পাওয়া সুযোগ তৈরি হয় সংক্ষুদ্ধ আবেদনকারীর। কারণ কমিশন সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে অনেক অনুকম্প দেখানোর সুযোগ থাকে। আবার কমিশনের তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন হলে সচিব এর মাধ্যমে এসে থাকে। তাই সচিবকে একটা স্টেজে রাখলে মন্দ হয় না। তবে এক্ষেত্রে সচিবকে সাধারণ মানুষের সমস্যা বিবেচনায় নিচের কর্মকর্তাদের চেয়ে সফটলি হ্যান্ডেলিং করতে হবে। তা না হলে দায়িত্ব বণ্টন নিয়ে সচিবের সিদ্ধান্তের সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে দ্বিমত পোষণ করেছেন সু-শাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। আর সরকারের যারা আমলা তাদের মধ্যে অনেক ধরণের অনিয়ম, অন্যায় ও অবিচার করার মানুষিকতা তৈরি হয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। আপলি কর্তৃপক্ষ কমিশনের পরিবর্তে সচিবকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত করার কারণে সমস্যা হতে পারে কি না জানতে চাইলে এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, হতেই পারে। কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় হতে পারে। আর নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবেদ আলী বলেন, আমাদের একটি দাবি ছিলো এনআইডি সংশোধন সংক্রান্ত কাজটি একটি জায়গা থেকে করা হ্কো। এখানে সচিবালয়ের প্রধান হিসেবে সচিবকে সাচিবিক অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেখানে আমলা হিসেবে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে সাধারণ একজন নাগরিক ন্যায় বিচার পাবেন, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় না। কারণ যারা সিদ্ধান্তটি বাতিল করছেন তারাও আমলা। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ যত বাড়বে, মানুষের হয়রানি তত বাড়বে। বলেন, অনেক সচেতন নাগরিকের এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে অনেক ভোগান্ত্রি পোহাতে হচ্ছে। এনআইডি সংশোধনের একক দায়িত্ব মহাপরিচালকের, তার কাছেই পৌছাতে একজন ভুক্তভোগীর কালঘাম ছুটে যায়; সেখানে সচিবের নাকাল পাওয়া কঠিন হবে। এনআইডির উপরে সচিব তার কর্তৃত্ব খাটাতে – এই দায়িত্ব বণ্টন করে নিয়েছেন। এখানে কমিশনকে রিভিশনের জায়গায় রেখে সচিবকে আপিল কর্তৃপক্ষ করা হয়েছে, যা সাংবিধানিক পদের মর্যাদাকে হানি করা হয়েছে। বলা যায়, এনআইডির সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘কমিশন আউট, ইন সচিব’। বলেন, আমাদের ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব ছিল, দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ সবক্ষেত্রে ডিজিটালাইজ হলেও এখানে কেনো হচ্ছে না। এর কারণ দুর্নীতি। তা না হলে একটি এনআইডি সংশোধনে এতো দীর্ঘসময় কেনো লাগবে। আর এতোগুলো জায়গায় কেনো যেতে হবে। তারপর একটি এনআইডি সংশোধন করতে হয় এখন আপিল কর্তৃপক্ষ সচিব হওয়ায় আবেদন কর্তৃপক্ষের অপেক্ষা আরও বাড়বে।