রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

এনআইডি সংশোধনে বিড়ম্বনা \ ক্ষুদ্ধ গ্রাহকরা

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২

জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে \ জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনে বিড়ম্বনা-ভোগান্তিতে ক্ষুদ্ধ গ্রাহকরা। উপজেলা শহর এবং ঢাকা প্রধান কার্যালয় ঘূরেই পার হয়ে গেছে অনেকের অর্ধ-যুগ। নানা দৌড়ঝাঁপ ও দেন-দরবারের পরও সংশোধিত এনআইডি হাতে পারছে না। ফলে সেবা গ্রাহীতা অনেকেই হতাশ। কি কারণে এবং কেনো সংশোধনের যোগ্য হচ্ছে না আবেদনটি সেটিও জানতে কারো কারো সময় লাগছে তিন থেকে চার বছর। ফলে পদে পদে ভোগান্তি সঙ্গী এখন বহু নাগরিকের। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আমলার সুপারিশ সত্তে¡ও পেছনে না ছূটলে নথির গতি থমকে থাকে। আবার করণীয় ভুল সংশোধনেও পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। নানা তদবির ও দেন-দরবার শেষে সংশোধনের অনুমোদন পেলেও দেখা গেছে আগের ভুলটিও রয়েছে। ফলে নতুন আবেদন করে আগের মতই দৌড়ঝাঁপ সেবা গ্রাহীতার জন্য নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে। এদিকে, নানা অভিযোগ ও ভুল-ভ্রান্তি ভুলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঢাকায় সব ধরণের আবেদন-সংশোধন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবেদনকারীকে এখন স্ব স্ব ভোটার এলাকার ইসি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হবে। তবে, সিইসি ও কমিশনার, সচিব ও এনআইডি ডিজির বিশেষ সুপারিশে দু-একটি জরুরি আবেদন-গ্রহণ নিস্পত্তির সুযোগ রাখা হয়েছে। সেটিও বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে। ফলে ইসির প্রধান কার্যালয়ে নাগরিকদের ভিড় কমতে শুরু করেছে। তবে মাঠে সুবিচার না পেয়ে অনেকেই ছুটে আসছেন এখানে। জানতে চাইলে এনআইডির ডিজি কে এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ভোটার পরিচবয়পত্রে নানা ত্র“টি রয়েছে। কিছু যৌক্তিক-কিছু অযৌক্তিক। কিন্তু সেবাগ্রহীতাদের সব আবেদন আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। যত দ্রুত সম্ভব যাতে এসব আবেদন নিষ্পত্তি করা যায়, সে চেষ্টা করা হচ্ছে। কমিশন এসব নাগরিকের বিষয়ে খুবই আন্তরিক। এমনকি সংশোধনের জন্য ক্র্যাশ-প্রোগ্রাম নেওয়া হতে পারে। তিনি আরও বলেন, নাগরিকদের কষ্ট লাঘবে প্রধান কার্যালয়ে সব ধরণের আবেদন গ্রহণ ও সংশোধন বন্ধ করা হয়েছে। যদি এখান থেকে কেউ সেবা পেতে আগ্রহী হন সেটা যদি জরুরি হয় তাহলেও নিয়ম অনুসরণ করেই করতে পারবেন। সরেজমিন ইসি কার্যালয়ে গত বুধবার কথা হয় কয়েকজন আবেদনকারীর সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক একজন আবেদনকারী বলেন, আমার ভাই সরকারের একজন সচিব। একটি আইডি সংশোধনের জন্য এনআইডির ডিজি মহাদয়কে তিনিই সুপারিশ জানান। ডিজি কথা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলেও নথির পেছনে না দৌড়ালে যথাস্থানে পড়ে থাকে। একটি টেবিলে তদবির করে ছাড়ালে অন্য টেবিলে সেটি পড়ে থাকে। আপসোসের সুরে বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের সুপারিশের পর আমার এই অবস্থা সাধারণ মানুষের কি হাল তা সহজেই বুঝে নেন। পাশের বসা সাইফুদ্দীন নামে একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক জানান, আমার এনআইডিতে ইংরেজি একটি শব্দে উলোট-পালট। এটি সংশোধনে শিক্ষাজীবনের সনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করেছিলাম। দীর্ঘদিনেও সংশোধন না হওয়ার পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আবেদনটি যেভাবে করা হয়েছিল ওইভাবেই পড়ে আছে। নানা তদবিরের পর আইডিটি সংশোধন হলেও দেখা যায়, আগের ভুলটিই রয়ে গেছে। তাই নতুন করে আবার অবেদন করেছি, দেখা যাক কয়দিনে সংশোধন হয়। মো রফিকুল ইসলাম। জাতীয় পরিচয়পত্র নং-৫৫১৫৯২৯৪০৩। পিতা ও বয়স সংশোধনে আবেদন করেছিলেন গত চার বছর আগে। উপজেলা অফিস থেকে ঢাকা অফিস ঘূরতে ঘূরতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। কিন্তু তার এই আইডি সংশোধন হবে কি না সে নিশ্চয়তা এখনও পাইনি। কি কারণে হচ্ছে না সেটিও তার কাছে অজানা। তাই নিরুপায় হয়ে এনআইডি ডিজির সাক্ষাত পেতে সকাল থেকেই অপেক্ষায় তিনি। পাশেই বসা সিরাজুল ইসলাম। এনআইডি নং ৫০৯৪৪০২৪৮৩। বয়স ১ জানুয়ারি ১৯৬০। কিন্তু সংশোধিত বয়স চান ১৯৫৪। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আবেদন করেন। গত ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত সংশোধনের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘূরলেও সঠিক পথ খুঁজে পারছেন না তিনি। এটি সংশোধিত না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন বন্ধ সিরাজুল ইসলামের। পাশেই বসা সিরাজুল ইসলামের ছেলে বলেন, বাবার একাডেমিক কোন সনদ নেই। তবে, আবেদন করার পর আড়াই বছরে এটি বাতিল হয়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে নাম সংশোধন চেয়ে আবেদন করেন মাধব হাওলাদার। তিনি নিজের নাম, পিতা ও মাতার নামে করণীক ভুল সংশোধন চান। সেখানে মাধব হাওলাদারের আগে শ্রী মাধব হালদার, পিতার নামে বুদ্ধেশর হাওলাদারের বদলে শ্রী বুদ্ধেশ্বর হালদার এবং মায়ের নামে শ্রীমতি হাওলাদারের পরিবর্তে শ্রীমতি হালদার করতে চান। কিন্তু তথ্য-যাচাই করে দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি সংশোধন হওয়ার কথা থাকলেও অংশোধিত অবস্থায় পড়ে আছে। সাতক্ষীরা কালিগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আকরাম হোসেন নামে আরেকজন এনআইডি সংশোধনের আবেদন করেছেন। উপজেলায় তদন্ত করে তার আইডিটি সংশোধনযোগ্য বলে সুপারিশ জানিয়েছেন বলেও জানান তিনি। কিন্তু এখনও অবধি সেটি সংশোধন হয়নি বলে জানা গেছে। শুধু মাধব, রফিকুল, সিরাজুল ও আকরাম নয় হাজারো মানুষ নিজ প্রয়োজনে এনআইডি সংশোধনের জন্য আবেদন করছেন। কিন্তু বছরের পর বছর আবেদনটি অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে থাকছে। এ ধরণের আবেদন ইসিতে লক্ষাধিক আবেদন জমা আছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া তথ্য হালনাগাদ না হওয়ার কারণে অনেক নাগরিকের এনআইডি নটফাউন্ড বলছে। সেবা নিতে গিয়ে পড়ছেন লজ্জায়। এমনিই একজন শফিকুল ইসলাম। সম্প্রতি ব্যাংক টাকা উঠাতে গিয়ে স্মার্টকার্ডের ফটোকপি জমা দেন। কর্তৃপক্ষ তথ্যটি যাচাই করে জানতে পারেন সেটি সঠিক নয় অর্থাৎ নটফাউন্ড আসছে। এতে তিনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। এ রকমের হরেক বিভ্রান্তির খোঁজ মিলছে ভোটারের তথ্যে। তথ্যভান্ডারে কোনো কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত স্টাটাসে ম্যাডনেস, ইনকমপ্লিট, ম্যাচ নট ফাউন্ড, ম্যাচ ফাউন্ড, মৃত ভোটার, তথ্য ডিলিট প্রদর্শিত হচ্ছে। বিশেষ করে ইসির তথ্যভান্ডারে ৪ হাজার ৩০০ ম্যাডনেস ভোটারের সন্ধান মিলেছে। এতে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাগ্রহীতারা। জানা গেছেম ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের ৮ কোটি ১০ লাখ ভোটারকে লেমিনেটিং কার্ড তুলে দেওয়ার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান শুরু হয়। সর্বশেষ গত ২ মার্চের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী দেশের ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ১০ হাজার। এই ভোটারদের কমপক্ষে অর্ধেকের মতো অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত কোনো সনদধারী নন। ১৩ বছর আগে দেশে ছবিসহ ভোটার তালিকা এবং ভোটারদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া শুরু হলেও এ বিষয়ে প্রদত্ত সব তথ্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে কি না, তা ভোটাররা আজও জানতে পারেননি। এমনকি ইসিকে তথ্য হালনাগাদের কোনো ঘোষণাও দেওয়া হয়নি। শুধু জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রদর্শিত তথ্যগুলো থেকে জানা গেছে এদিকে এনআইডি সংশোধন নিয়ে নানা হয়রাণীর অভিযোগ রয়েছে। ইসির সংলাপে অংশ নিয়ে সুশীল সমাজের অনেক প্রতিনিধি অভিযোগ করে বলেন, একটি এনআইডি সংশোধনে ক্ষেত্রবিশেষে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। এনআইডি সংশোধনে অনিয়মের কারণে অনেক কর্মকর্তার চাকরিচ্যুত হয়েছেন এবং অনেকেই শাস্তিরমুখে সাময়িক বরখাস্ত আছেন। স¤প্রতি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা নিতে নাগরিকরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। কর্মকর্তাদের জনসেবা দিতে গিয়ে প্রভুর মতো আচরণ না করে সেবক হিসেবে কাজ করারও তাগিদ দেন তিনি। সিইসি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন অপরিসীম। এনআইডিতে ভুল বিভিন্ন কারণে হতে পারে। ভুল সংশোধন নিয়ে অনেকেই আসছেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের সেবক হিসেবে কর্মকর্তাদের কাজ করতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com