স্টাফ রির্পোটার\ জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলা সদরের বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সামাদ স্মৃতি ফুটবল মাঠে বিজয় মেলায় চলছে “ওঠাও বাচ্চা” লটারীর রমরমা আসর। অভিযোগ, সাংবাদিক, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করেই মেলার মুল ফটকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি লাগিয়ে নামমাত্র পুরষ্কার দিয়ে প্রতিদিন লুটপাট করা হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা। সরেজমিনে রবিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কালিগঞ্জ, দেবহাটা ও শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কালিগঞ্জ শহীদ সামাদ স্মৃতি ফুটবল মাঠ, বাসটার্মিনাল, ফুলতলা, কলেজ মোড়, মৌতলা বাজার, নলতা চৌরাস্তা মোড়, পিরোজপুর মোড়, কুশুলিয়া হাটের মোড়, কালিবাড়ি বাজার, উজিরপুর বাজার, তারালী বাজার, শ্যামনগর বাসস্টান্ড, বংশীপুর মোড়, দেবহাটার হাদিপুর, সখীপুর, পারুলিয়া বাসস্টান্ড, আশাশুনি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কালিগঞ্জের বিজয় মেলা-২০২২ উপলক্ষে চটকদারী পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়ে চলছে লটারীর মাইকিং এবং টিকিট বিক্রি। লটারীর প্রতিদিনের টিকিটের মূল্য ২০ টাকা। যদিও প্রচার ইজিবাইকের পিছনে লেখা আছে প্রবেশের টিকিটের উপর পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠান। কিন্তু মেলায় প্রবেশের ক্ষেত্রে দর্শনার্থীদের কোন ধরনের ব্যাবস্থা নেই উম্মুক্ত রাখার হয়েছে মেলায় প্রবেশ পথ। গত শনিবার আকর্ষণ হিসেবে ৬১টি পুরষ্কারের মধ্যে প্রথম পুরষ্কার সুজুকী গাক্সীর ১৫৫ সিসি মটর সাইকেল, ৩১তম ও শেষ পুরষ্কার হিসেবে একটি করে ৮০ সিসি রানার মটর সাইকেল একজোড়া করে দুজনের সোনার কানের দুল ও ১০টি মোবাইল সেট পুরষ্কার হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। শহীদ সামাদ স্মৃতি ফুটবল মাঠে অনুষ্ঠিত বিজয় মেলার প্রধান ফটকের বাম দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডাঃ আ.ফ.ম রুহুল হকের ছবি লাগানো রয়েছে। ডান দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কালিগঞ্জ থানা আ‘লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোট এর ছবি শোভা পাচ্ছে। মেলা শুরুর প্রথম আট দিনে একটি লটারী টিকিটের মূল্য ১০ টাকা ও তারপর থেকে লটারী টিকিটের মূল্য ২০ টাকা ধার্য করা হয়েছে। রবিবার টিকিট ফেলার জন্য ৭৬টি বক্স ও প্রচারণার জন্য ২৮টি ইজিবাইকের এর ব্যবস্থা করেছেন “ ওঠাও বাচ্চা” লটারীর পরিচালক মানিক শিকদার। কালিগঞ্জ উপজেলার মধ্যে একজন ইজিবাইক চালককে দেওয়া হচ্ছে এক হাজার টাকা। উপজেলার বাইরে গেলে দেড় হাজার এবং টিকিট বিক্রি ও প্রচারকারী পাচ্ছেন ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা। যারা বিভিন্ন স্থানে বসে টিকিট বিক্রি করছেন তারা প্রতিদিন পাচ্ছেন ৫‘শ থেকে ৭‘শ টাকা। রাত ১০টার পরপরই লটারী শুরুতেই দর্শণার্থীদের মধ্যে একজন বাচ্চাকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে তার চোখে কালো কাপড় বেঁধে চারকোনায় চারজনকে দাঁড় করিয়ে কাপড় টানিয়ে ঢালা হয় বিক্রিত টিকিটের মুড়ি বা ছোট অংশ। এরপর ওই বাচ্চা এক এক করে নির্ধারিত পুরষ্কারের আলোকে সেই কয়টি লটারীর টিকিটের মুড়ি অংশ তুলে ধরে সকলের সামনে। এর পর ওই লটারীর নাম্বার মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। এবং ফোন করে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয় আপনার নম্বরে লটারীর পুরস্কার বেঁধেছে নিয়ে যান। উপজেলা সদরের বাজারগ্রাম রহিমপুরের ওমর ফারুখ, তেঁতুলিয়া গ্রামের সাজ্জাত আলী ও নলতা আহছানিয়া মিশন এলাকার রফিকুল ইসলাম জানান, গত ৩০ ডিসেম্বর রাত ৭টায় কালিগঞ্জ সড়ক ও পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনির সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আবু তাহেরের পরিচালানয় মাস ব্যাপি বিজয় মেলার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য, জেলা আ‘লীগের সহ-সভাপতি সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডাঃ আ.ফ.ম রুহুল হক। খোঁজ খবর নিয়ে জানাযায়, ১ মাস ৭ দিন ব্যাপি বিজয় মেলার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর এক মাস সাত দিনের এ মেলার চালানোর অনুমতি দেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নেজারত শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট (এনডিসি) বাপ্পি দত্ত রণি। ৩০ ডিসেম্বর থেকে অনুমোদন পাওয়া মেলায় যাত্রাপালায় নগ্ন নৃত্য, লটারী, জুয়া ও হাউজি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ কালিগঞ্জসহ সাতক্ষীরার ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠণের নেতা, কয়েকজন বড় মাপের জনপ্রতিনিধি কালিগঞ্জের বেশ কিছু সাংবাদিক, সাতক্ষীরার চারটি সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান, ছোট-বড় খুচরা অনলাইন সাংবাদিক ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই প্রতিদিন এ রক্তচোষা জুয়া চলছে। গত এক সপ্তাহের পুরষ্কারের হিসাব করে তারা বলেন, প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকার পুরষ্কার দেওয়া হয়। অথচ প্রতিদিন ২২ থেকে ২৫ লাখ টাকার লটারীর টিকিট বিক্রি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এক মাস সাত দিন মেলা চললে প্রথম ৮ দিনের ১০ টাকা লাটারীর টিকিট ও পরবর্তী সময়ের বিক্রিত লাটারীর টিকিট মূল্য থেকে পুরষ্কার মূল্য, ইজিবাইক, প্রচারকারি, ডেকরেটরসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে মোট ৬০ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে আয়োজক কমিটির। সচেতন মহল জানান, লটারী টিকিট কেটে পুরষ্কারের নামে এলাকায় বাড়ছে চুরি ও ছিনতাই। বাড়ি থেকে জিনিসপত্র ও টাকা চুরি করে লটারী টিকিট কিনতে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের টাকা দিয়ে প্রতিদিন মোটা অংকের লটারীর টিকিট কিনতে যেয়ে অনেকেই হচ্ছেন সর্বশান্ত। এছাড়াও ঘটছে পারিবারিক অশান্তি। অবিলম্বে এ লটারী বন্ধের দাবি জানান তারা। উপজেলার মুকুন্দ মধুসুধনপুরের ইসমাইল হোসেন পেশায় ভ্যানচালক। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে মেলা উদ্বোধনের পর থেকে ২০ থেকে ২৫টি করে টিকিট কিনেছেন। শনিবার পর্যন্ত ১৫ দিনে একটি পুরষ্কার পাননি তিনি। অথচ বাড়িতে চাল ও বাজার কম করার প্রতিবাদ করতে যেয়ে স্ত্রী রমেছা খাতুনকে টিপিয়ে কোমরের হাড় খেঙে দেওয়া হয়েছে। তাকে গত বুধবার সাতক্ষীরার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সাদপুরের রুবেল হোসেন। পেশায় বাসের হেলপার। প্রতিদিন যে টাকা আয় হয় তাতে ১০টির বেশি টিকিট কেনা যায় না। বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েও বেশি টিকিট কিনেছেন। এখন আর কেউ টাকা ধার না দেওয়ায় বাড়ির লোহার শাবল চুরি করে শুক্রবার রাতে ৯০ টাকায় বিক্রি করে অতিরিক্ত চারটি টিকিট কিনেও পুরষ্কারের ভাগ্য খোলেনি রুবেলের। কাঁকশিয়ালী গ্রামের ইমান আলীর ছেলে নজরুল ইসলাম নজু পুরষ্কারের লোভে প্রতিদিন ১০০ থেকে দেড়শত টিকিটি কিনেছেন। বিক্রি করেছেন একটি গাভী ও কয়েকটি হাঁস মুরগি। গত ১৫ দিনে লটারীর পিছনে খরচ করেছেন প্রায় ৫০ হাজার টাকা। প্রতিবাদ করে লাভ না হওয়ায় শনিবার সকালে স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। একইভাবে মেলার পাশের্^ বাস টার্মিনালের সৈনিক হোটেলের মালিক অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্য মৃতঃ মিলন হোসেনের ছেলে সেলু প্রতিদিন বড় অংকের টিকিট কেটেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে। এখন চলছে প্রতিনিয়ত অশান্তি। একইভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সের মোড়ে আজগার আলীর ছেলে চায়ের দোকানদার সিরাজুল ইসলাম সিরাজ স্ত্রী ও ছেলেকে দোকানে বসিয়ে ছুটেছেন লটারীতে মোটর সাইকেল পাওয়ার আশায়। প্রতিদিন কিনেছেন ৭০ থেকে ১০০ টি লটারী টিকিট। এখন তার বাড়িতে হাঁড়ি না জ্বলার উপক্রম। উড়ে গেছে সংসারের শান্তি নামের সাদা পায়রাটি। লটারী কিনে পুরষ্কারের লোভে পূর্ব নলতার আজগার আলী, কুশুলিয়ার রাজিব, শ্যামনগরের বাধঘাটার রুহুল আমিন, সখীপুরের আবুল বাসারসহ অনেকে এ পর্যন্ত ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার টিকিট কিনেও তাদের কপালে কিছু জোটেনি। এ ব্যাপারে কালিগঞ্জ শহীদ সামাদ স্মৃতি ফুটবল মাঠে বিজয় মেলা উপলক্ষে লটারীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানিক শিকদার রবিবার দুপুরে এ প্রতিবেদককে বলেন, লটারী না হলে মেলা চলে না। কিছুক্ষণ পরে তিনি শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে আসবেন। দেখা করার অনুরোধ জানান তিনি। মেলার দায়িত্বে থাকা কালিগঞ্জ সড়ক ও পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনি ও সামাদ স্মৃতি ফুটবল মাঠের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ বলেন, মেলা চলছে ঠিকই তবে অনুমোদন বিহীন লটারী চলছে না একথা বলা যাবে না। তবে এটি একটি আনন্দের বিষয় বলে সেখানে যাওয়ার আহবার জানান তারা। উপজেলা আ‘লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোট জানান, মেলায় প্রবেশের টিকিট দিয়ে লটারী করা হয় বলে তিনি জানেন। তবে প্রকাশ্যে লটারী বিক্রির কথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় তাকে অবহিত করলে তিনি বিষয়টি মানিক শিকদারকে ডেকে সতর্ক করেছিলেন। তবে আ‘লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠণের কোন নেতা লটারী নিয়ে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয় দাবি করে তিনি বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মাদ মামুন রহমান বলেন, অনুমতি ছাড়াই লটারী চলছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রহিমা সুলতানা বুশরা জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। যে কোন সময় লটারী বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোঃ হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে রবিবার বিভিন্ন সময়ে মোবাইলে যেগোযোগ করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মেলার অনুমতিপত্রে সাক্ষরকারি নেজারত শাখার নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট বাপ্পি দত্ত রণি বলেন, বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।