এফএনএস : দুর্নীতির দুষ্টচক্র সরকারি খাতে জেঁকে বসেছে। এই দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে সরকারি খাত থেকে লোপাট হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এই দুষ্টচক্রের খপ্পরে সরকারের অনেক সদিচ্ছাও হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। উন্নয়ন কর্মকান্ড গতি হারাচ্ছে। ফলে দেশ এক ধরণের বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অজান্তেই। জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে তাও দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে হুমকির মুখে পড়ে গেছে। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ যে প্রতিবছর প্রবৃদ্ধি হারাচ্ছে তা বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বাদেও পাওলো মওরো গবেষণায়, এবং আরও বহু গবেষণা উঠে এসেছে। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক রিপাবলিক ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে পরিচালিত এক জরিপে ব্যাপক দুর্নীতি ও বৈষম্য বিষয়ে মানুষ গভীর হতাশা প্রকাশ করেছে এবং তারা দুর্নীতিকে দেশের ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০২০-এর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তানের নিচে ও শুধু আফগানিস্তানের ওপরে। আফগানিস্তান তার অবস্থান ২০১২-এর পর থেকে ১১ ধাপ উন্নতি করেছে আর নেপাল করেছে ৬ ধাপ। এমনকি মিয়ানমারও ২০১৩-এর পর থেকে ১৩ ধাপ উন্নতি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্কোর ২০২০ সালে ছিল ২৬, যা তার ২০১২-এর স্কোরের সমান। সরকারের এমন কোন খাত নেই, অনুদান প্রকল্প নেই যেটি দুর্নীতি ও অনিয়মের কালো থাবা থেকে মুক্ত। এমনকি দরিদ্রের জন্য বরাদ্দকৃত শীতের কম্বল বাজেটের অর্ধেক টাকা ঢুকেছে দুর্নীতিবাজদের পকেটে। স¤প্রতি জানা যায়, সরকারি ব্যয়ের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন প্রকল্প, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি, জ¦ালানি তেল ক্রয়, খাদ্য বিতরণ, ব্যাংক, বিমা ও রাজস্ব খাত ঘিরে এ অনিয়ম হয়। পাশাপাশি কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য বিদেশি প্রকল্পে সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়ম ধরা পড়ে। করোনাকালেও থেমে ছিল না শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গরিব মানুষের খাদ্য বিতরণের টাকা ব্যয়ে অনিয়ম। যা নিরীক্ষা বিভাগের ২০২০-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয় থেকে শিগগিরই আর্থিক অনিয়মের এ প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হবে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও অডিট আপত্তির সম্পূর্ণ অর্থ সমন্বয় হবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে দুর্নীতির সামান্য কিছু অর্থ আদায়ের পর বাকিগুলো অনিষ্পন্ন অবস্থায় ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। হয়তো এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী, অডিট রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। এরপর তা সরকারি হিসাব কমিটিতে চলে যায়। ওই কমিটি রিপোর্ট পর্যালোচনাকালে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে বিশ্ব করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত। অনেক দেশের স্বাস্থ্যখাত নাজেহাল অবস্থায় পড়ে গেছে। আমাদের দেশেও স্বাস্থ্য অবস্থার চিত্র ছিল করুণ। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের এই নাজুক অবস্থার সুযোগ নিয়েও এ দেশে দুর্নীতিবাজরা নিজের পকেট ভরিয়েছেন। সূত্র জানায়, এ বছর যেসব আর্থিক অনিয়ম শনাক্ত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে কয়েক ধরনের কৌশলে এগুলো সংগঠিত হয়। এরমধ্যে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিদেশি প্রকল্পে সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতি হয়েছে ব্যাপকভাবে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা, নিয়মবহির্ভূত ব্যাংক ঋণ ইস্যুর মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ তছরুপ করা হয়েছে। পাশাপাশি পণ্য রপ্তানির নগদ সহায়তা, আয়কর হিসাবে গরমিল ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় অমিল, সাবরেজিস্ট্রার অফিসগুলোর হিসাবেও অনিয়ম ধরা পড়েছে। এসব দুর্নীতি ও অনিয়মকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি বা লোকসান হিসাবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে চলমান দুর্নীতির কিছুকিছু চিত্র জনসাধারণের সামনে উন্মোচিত হয়েছে, যা খুবই ভয়াবহ, হাস্যকর ও লজ্জাজনক। ‘বেক্সিমকো প্রতিটি ভ্যাকসিন থেকে ৭৭ টাকা করে মুনাফা করবে’, এটা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের একটা উদাহরণ, যেখানে তারা সরকারকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। বিনিময়ে সরকার তাদেরকে জনগণের স্বার্থের বিপরীতে অন্যায্য সুবিধা দেয়। ‘একটা বালিশ কেনা হয়েছে ৫৯৫৭ টাকায়’; ‘একটা চামচের দাম পড়েছে ৯৭ হাজার টাকা’; ‘৫৫০০ টাকার বই কিনতে লেগেছে ৮৫,৫০০ টাকা’; ‘একটা পর্দার দাম ধরা হয়েছে ৩৭,৫০০ টাকা’। এই ঘটনাগুলো মালামাল ও সেবা ক্রয় এবং ‘নানাবিধ’ বা আকস্মিক খরচ ইত্যাদির নামে আসলে রাষ্ট্রের কোষাগার লুণ্ঠনের উদাহরণ। অন্য আরেক রকম তছরুফের ঘটনার উদাহরণ হলো, ‘চিনাবাদাম চাষ শিখতে ১১৬ কর্মকর্তা বিদেশে যাবেন’; ‘পুকুর খনন শিখতে ১৬ জন কর্মকর্তা বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত’। এটি স্পষ্ট যে, কোন মন্ত্রণালয়ে কত টাকা বরাদ্দ করা হবে, তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে ও পরে ক্যাবিনেটে অনুমোদন করতে হয়। কোনো মন্ত্রণালয়ে কেনাকাটায়, অনর্থক বিদেশ গমনে ও ‘নানাবিধ’ বা আকস্মিক ব্যয়ের নামে অর্থ তছরুফের ঘটনা যাতে না ঘটে, তা রোধ করতে হলে ইফিসিয়েন্সি রেটিং করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এই রেটিংয়ের ওপর ভিত্তি করে চলতি ব্যয় বরাদ্দ করতে হবে এবং দুর্নীতির বিচারের পাশাপাশি চলতি ব্যয় কমিয়েও শাস্তি দিতে হবে। আর ইফিসিয়েন্সি মানে হলো কম সময়, কম খরচ, কিন্তু উচ্চ মান। এই তিনের সমন্বয়ে গঠিত কম্পোজিট ইনডেক্স দিয়ে মন্ত্রণালয়ের মান নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনের জন্য একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থাই গঠন করা হয়েছে, যেটির নাম দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু এই কমিশনের কাজ খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়, বরং এটি এ পর্যন্ত হতাশার পরিচয়ই দিয়ে এসেছে। দুর্নীতি দমনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সংস্থাটি বলতে গেলে ব্যর্থ। তবে অনেকে মনে করেন যে দুদকের এখনো অনেক কিছু করনীয় আছে। চেষ্টা করলেই সংস্থাটি দুর্নীতি নির্মূল করতে অগ্রণী ভ‚মিকা রাখতে পারে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সুপারিশ নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে শিথিলতা আছে। এ ছাড়া অডিটের সুপারিশ বাস্তবায়নে কম গুরুত্বারোপ করা হয়। পাশাপাশি কার্যকর অভ্যন্তরীণ অডিটের অনুপস্থিতি, সুশাসনের ঘাটতি এবং বাজেট প্রাক্কলন ও বাস্তবায়নে সক্ষমতার স্বল্পতা রয়েছে। যে কারণে একদিকে একই বিষয়ে অডিট পুনরাবৃত্তি হচ্ছে অন্যদিকে অডিটের সংখ্যাও বাড়ছে।