কয়রা প্রতিনিধি ॥ আগামী ১৭ জুন মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আযহা অথ্যাৎ (কুরবানীর ঈদ)। এ ঈদকে সামনে রেখে চুলায় দগদগে আগুনে গরম লোহার পিটাপিটিতে টুং টাং শব্দে মুখর হয়ে উঠছে কয়রার আমাদী বাজারের রাস্তার পাশে কামার দোকানগুলো। চলছে হাঁপর টানা, পুড়ছে কয়লা, জ¦লছে লোহা। হাতুড়ি পিটিয়ে কামার তৈরি করছেন দা, বটি, ছুরি, কুড়াল, কোদাল,কোরবানির গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া জবেহ করার ছুরিসহ মাংশ কাটার চা পাতি তৈরিতে স্থানীয় কামাররা ব্যস্ত সময় পার করছেন। দোকানের জ¦লন্ত আগুনের তাপে কামারদের কপাল থেকে ঝরছে ঘাম। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। তবুও তেমে নেই সকাল পেরিয়ে রাত পর্যন্ত চলবে হাতুড়ির পেটার কাজ। এ সময়ে কামারদের দম ফেলার ফুসরত নেই। তারা ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে রাত দিন এক করে এসব হাতিয়ার তৈরিতে নির্ঘুম রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। কয়লার দগদগে আগুনে লোহাকে পুড়িয়ে পিটিয়ে তৈরি করছেন সব ধারালো সামগ্রী। তবে এসব তৈরিতে এখনও আধুনিকতার ছোয়া লাগেনি। পুরানো নিয়মেই চলছে আগুনে পুড়ে লোহা হতে ধারালো সামগ্রীর কাজ। তবে কয়লা ও লোহার দাম বেড়ে যাওয়ায় বাপ দাদার ব্যাবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে কামার শিল্পিরা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করেছেন কামাররা। প্রতি বছর কোরবানির ঈদে তাদের জিনিস পত্রের বেচাকেনা বেড়ে যায়। এ অর্জিত টাকায় সারা বছরের খোরাক জোগাড় করেন। অথচ বছরের বেশিরভাগ সময়ই কামার শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা এক প্রকার বেকার সময় কাটান। সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহকালে বুধবার (১২ জুন) সকাল থেকে উপজেলার আমাদী বাজার , কয়রা বাজার সহ বেশ কিছু কামারশালা ঘুরে দেখা যায় পশু কোরবানির জন্য দা, ছুরি, চাপতি সহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে কামারপাড়ার ঢুঁ মারছেন সাধারণ মানুষ। এ সময় কথা হয় কোরবানির পশুর মাংস কাটার জন্য চাপতি কিনতে আসা ও বটি ছুরিতে শান দিতে আসা মহারাজপুর এলাকার ক্রেতা আঃ হালিম খোকন, কালনার সোবহান, শ্রীরামপুর গ্রামের ওসমান গনি সহ অনেকের সাথে। তারা জানান, সারা বছর এগুলোর কোন কাজ না করায় নষ্ট হয়ে থাকে। শান দিয়ে পুরাতনগুলো দিয়ে মাংশ কাটার কাজ চালিয়ে দিবেন। শুধু একটা ছুরি ও চাপাতি কিনব। আর শান দিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা নেন কর্মকার। কামার শিল্পি রফিকুল কর্মকার বলেন, আমার দাদা কর্মকার ছিলেন, বাবাও কর্মকার আমি ল্যাংটা বেলা থেকে আজ ৬০ বছর যাবত এ পেশায় নিয়োজিত আছি। আমার দুইটা ছেলে বড় ছেলেও এ পেশায় কাজ করছে। বড় ছেলের ছেলে আমার পোতা ৭ বছর বয়স স্কুলে যাওয়ার পাশাপশি হাটুর পেটানো শিখিয়েছি। গরিব মানুষ লেখাপড়া করাতে না পারলে এই কাজ করবে। আমাদী বাজারে আমরা এখানে ৫০ টার মত কামারশালা আছে। এখানে তিন ধরনের কামার আছে, জাত কামার, মুসলমান কামার ও ধোপা কামার। বছরে আমাদের দুইবার ভাল কাজ হয়। পৌষমাসে ধান কাটর সময় আর কোরবানীর ঈদ আসলেই আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়, আমরাও এ দু’ সময়ের অপেক্ষায় থাকি। ঈদ মৌসুমটাই আমাদের মূল টর্গেট থাকে। সারা বছর বেচাকেনা কম থাকে, কোনো রকম দিন যায়। কারিগরদের বেতন দিয়ে খুব একটা থাকে না। কোরবানীর ঈদের আগে এক দু’ সপ্তাহ ভাল বেচাকেনা হয়। ৫০ বছর বয়সী কর্মকার অসীম জানান, বছরের অন্য সময়ের চেয়ে কোরবানির ঈদে তাদের আয় রোজগার অনেক বেশি হয়। এবার প্রতিটি ধারালো দা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, কুড়াল ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা, কোদাল ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, কোরবানির পশু জবাহ করা ছুরি ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা, পশুর হাড় কাটার জন্য চাপাতি ৬০০ থেকে ১১০০ টাকা চামড়া ছাড়ানোর জন্য চাকু ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, নারিকেল কোরানি ১০০ থেকে ১৬০ টাকা। তাছাড়া অন্যান্য কৃষি উপকরণ ধানকাটার কাচি, লাঙ্গলের ফালাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ভাল দামে বিক্রি হয়ে থাকে। এ সময় মসজিদকুড় মোড়ের আগে শাহাবুদ্দিন সরদার কর্মকার বলেন, ঈদে চাপতি , দা,ছুরির ব্যাপক চাহিদা থাকায় আমাদের কাজের ব্যস্ততা বেশি। তবে বাজারে রেডিমেট আমদানিকৃত হাতিয়ার আসায় আমাদের তৈরি হাতিয়ারের চাহিদা বহুগুণে কমে গেছে। তারা বাজারে রেডিমেট ছুরি যাহা মালে ভাল না, বেশিদিন থাকেও না কিন্তু দাম কম পাওয়ায় মাত্র ৭০ টাকায় ক্রয় করে নিয়ে যায়। চায়না থেকে কোদাল আসে এগুলো ২০০ থেকে ২৫০ বিক্রি হয়। যে গুলো খুব পাতলা। যে গুলা আমরা তৈরি করি রেল পাটি অথবা জাহাজের পাটি দিয়ে সে গুলো অনেক পুরু ও মজবুত হয় এজন্য দাম বেশি। ফলে পূর্বপুরুষদের পেশা ধরে রাখা দুষ্কর হবে বলেও মন্তব্য করেন তারা। এমনকি এ পেশা ধরে রাখতে কমার শিল্পের প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন তারা। তারা জানান, কয়লা, লোহার দাম উঠা নামা করে এজন্য যদি বেশি করে আমরা একসাথে কিনে রাখতে পারি তাহলে লাভবান হতাম। এজন্য সরকার যদি আমাদের জন্য স্বল্প সুদে লোনের ব্যাবস্থা ও সরকারি সহায়তা ও আর্থিক অনুদানে উপকৃত হবেন তারা।