এফএনএস: চাঁদপুরে মেঘনায় সারবাহী কার্গো জাহাজ এমভি আল বাখেরার সাত স্টাফকে চেতনানাশক কিছু খাইয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে নৌপুলিশ। এদিকে একই দাবি করছে র্যাবও। এই ঘটনায় আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফান নামে একজনকে বাগেরহাটের চিতলমারী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব—১১ এর সদস্যরা। এই ঘটনায় গত মঙ্গলবার রাতে হাইমচর থানায় অজ্ঞাত ডাকাত দলের বিরুদ্ধে মামলা করেন জাহাজের মালিক মাহাবুব মোর্শেদ। ওই মামলার এজাহারে তিনি এই আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফানের নাম উল্লেখ করেন। এতে বলা হয়, আহত জুয়েল জানিয়েছেন, জাহাজে নবম ব্যক্তি হিসেবে ইরফানও ছিল। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস দাবি করেন, দীর্ঘদিন ধরে বেতন ভাতা না পাওয়া ও দুর্ব্যবহারের ক্ষোভ থেকে আকাশ মন্ডল ইরফান জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়াসহ সবাইকে হত্যা করে। ইরফান জাহাজের সুকানির সঙ্গে ইঞ্জিনরুমে কাজ করতো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইরফানের দেওয়া তথ্যমতে র্যাব আরও দাবি করে, জাহাজের বাজার করার জন্য ইরফান পাবনার একটি বাজারে নেমেছিল। সেখান থেকে তিন পাতা ঘুমের ওষুধ কেনে। আর যে চাইনিজ কুড়াল দিয়ে সবাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সেটি আগেই জাহাজেই ছিল। কুড়ালটি জাহাজের নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছিল। আগের দিন রাতের খাবার রান্নার সময় ইরফান জাহাজের বাবুর্চির অগোচরে খাবারের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। সেই খাবার খেয়ে সবাই অচেতন হয়ে পড়লে হাতে গ্লাভস পরে চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে মাস্টারসহ সবাইকে হত্যা করে। ঘটনা যাতে জানাজানি না হয় সে জন্য ইরফান মাস্টারসহ সবাইকে হত্যা করে। সংস্থাটির দাবি, যখন সবাইকে কুপিয়ে হত্যা করে তখন জাহাজ মাঝ নদীতে নোঙর করা ছিল। পরে সবার মৃত্যু নিশ্চিত করে নিজে জাহাজ চালিয়ে হাইমচর এলাকায় এসে অন্য ট্রলার দিয়ে পালিয়ে যায়। এদিকে, নৌপুলিশ বলছে, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পেলেও ক্রাইম সিন দেখে বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ নিহতদের সবার লাশ নিজ নিজ ঘুমের ঘরে পাওয়া গেছে। যেন সবাই ঘুমাচ্ছে। সবার মাথায় গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। জাহাজে কাউকে আক্রমণ করলে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করবে, চিৎকার করলে অন্যরা রক্ষা করতে আসবে— কিন্তু এখানে তেমন মনে হচ্ছে না। এ অবস্থায় সবদিক মাথায় রেখে কাজ করছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো। ইতোমধ্যেই জেলা পুলিশ, নৌপুলিশ, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের স্বজন ও নৌযান শ্রমিকদের দাবি, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আগামী দুই দিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ২০ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দাবি করেছেন নৌযান শ্রমিকরা। তা না হলে সারা দেশে ২৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে কর্মবিরতির মাধ্যমে নৌপথ বন্ধ রাখার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে নৌপুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, আমরা খবর পেয়ে জাহাজে গিয়ে লাশগুলো নিজ নিজ শয়নকক্ষে পেয়েছি। শীতের দিনে আমরা যেভাবে লেপ—কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা দেখে মনে হচ্ছিল নিহতরাও সেভাবে ঘুমিয়ে আছেন। তাদের প্রত্যেকেরই মাথায় আঘাত। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা মনে করি, কেউ কাউকে মারতে গেলে বা কেউ যখন নিশ্চিত হয় আমাকে হত্যা করতে আসছে, তখন তিনি জীবন রক্ষায় হাত দিয়ে হোক, পা দিয়ে হোক— যেকোনোভাবেই হোক তিনি নিজেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করবে এবং তাদের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত থাকার কথা। কিন্তু প্রত্যেককে আমরা পেয়েছি শুধু মাথায় আঘাত অবস্থায়। তিনি বলেন, একটি রুমে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটালে চিৎকার বা সাড়াশব্দে পাশের রুমে শব্দ পাওয়ার কথা এবং তারা সবাই একত্রিত হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে সেরকম কিছু মনে হয়নি। আবার ডাকাতরা যেটি করে থাকে— সবাইকে একরুমে নিয়ে এসে তারপর ডাকাতি করে। এখানে সেরকম পাইনি, সাতটি লাশ পেয়েছি সাতটি ভিন্ন ভিন্ন রুমে। সেক্ষেত্রে বলা যায়, তাদেরকে হয়তো চেতনানাশক প্রয়োগ করা হয়েছিল বা কোনও ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। নৌপুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ময়নাতদন্তের পর লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা ভিসেরা রিপোর্ট প্রস্তুত করছি। ভিসেরা রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট গবেষণাগার থেকে এটির সায়েন্টিফিক রেজাল্ট পেলে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবো এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কি কারণ ছিল। ধারণা করে তিনি আরও বলেন, লাশগুলো পর্যবেক্ষণে আমাদের মনে হয়েছে, এটি একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যে বা যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তারা সম্ভবত জাহাজটি চট্টগ্রামের যে বন্দর থেকে আসে সেখান থেকে নাবিকদের সঙ্গেই ছিল। এখন পর্যন্ত (২৪ ডিসেম্বর বিকাল) আমাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জাহাজে আট জন নাবিক ছিলেন। এর মধ্যে সাত জন নিহত হয়েছেন এবং একজন গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালমা নাজনীন তৃষা বলেন, খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখলাম, জাহাজের নিচের ফ্লোরে একটি চাইনিজ কুড়াল রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এটি ছিল সারের জাহাজ। কিন্তু সারগুলো টোটালি ইনট্যাক্ট ছিল। কেউ ডাকাতি করতে এলেতো সার বা জাহাজ কোন কিছুতো নিয়ে যাবে— কিন্তু এগুলো কিছুই হয়নি। যে মানুষগুলোকে কোপানো হয়েছে হয়তো তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় কোপানো হয়েছে। বা এমনও হতে পারে— তাদেরকে মেরে ফেলার পর চাদর দিয়ে ঢেকে রেখে গেছে বিছানায়। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি আসলে তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে এটির মোটিভটি কী? এটি কি ডাকাতি ছিল নাকি পার্সোনাল কোনো কনফ্লিক্ট থেকে এটা করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না। মামলার বাদী এজাহারে জাহাজে থাকা সাত জন খুন ও একজন আহতের কথা উল্লেখ করেন। খুন হওয়া ব্যক্তিরা হলেন— মাস্টার গোলাম কিবরিয়া, গ্রিজার সজিবুল ইসলাম, লস্কর মাজেদুল ইসলাম, শেখ সবুজ, আমিনুর মুন্সী, ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিন ও বাবুর্চি রানা কাজী। এ ছাড়া আহত ব্যক্তি হলেন— সুকানি জুয়েল (২৮)। তিনি ফরিদপুর সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের সেকান্দর প্রকাশ সেকেন্ড খালাসীর ছেলে।