এফএনএস : দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিরূপ প্রকৃতি এবং কৃষিতে ব্যবহৃত পণ্যমূল্য বৃদ্ধি খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে। বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান থেকেই সবচেয়ে বেশি ৫৫ শতাংশ চাল আসে। আর আমন ধান থেকে আসে ৩৯ শতাংশ চাল। বাকিটা আউশ থেকে আসে। এবার প্রায় ৩০ শতাংশ জমিতে আমন চাষ কমেছে। বিগত আউশ মৌসুমেও ধানের উৎপাদন কম হয়েছিল। আর আসন্ন বোরো নিয়ে চিন্তা রয়ে গেছে। আর চলতি আমন ও আসন্ন বোরোর উৎপাদন ব্যাহত হলে খাদ্য উৎপাদনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কৃষি বিভাগ এবং কৃষি বিশেষজ্ঞদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আবহাওয়ার চরম বৈরী আচরণে এবার আমন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষক জমিতে সেচ দেয়ার জন্য সময়মতো বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, বেড়েছে ডিজেলের দাম। আর সিন্ডিকেটের কবলে সার। সব মিলিয়ে দেশের কৃষকরা চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি। এবার ৩০ শতাংশ জমিতে কমেছে আমন চাষ। কৃষকদের এমন বৈরী পরিস্থিতি মুখোমুখি হওয়ার কারণে আসন্ন বোরো মৌসুমেও ধান চাষে ভাটা পড়ার শঙ্কা রয়েছে। সেচ-সারের অভাব ও বাড়তি খরচায় কৃষকরা অনাগ্রহী হতে পারে। ডিজেলের বর্তমান দাম বহাল থাকলে আসন্ন বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন খরচ বহুগুণ বাড়বে। কৃষকপর্যায়ে সেচ খরচ বাড়বে। পাশাপাশি ধান কাটা, মাড়াই ও সরবরাহেও প্রভাব পড়বে। অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়ায় কৃষকদের লোকসান গুনতে হতে পারে। আর ক্রেতাদের চড়া দামে চাল কিনতে হবে। সূত্র জানায়, দেশের ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ৩৩ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র দিয়ে সেচ দেয়া হয়। বিঘার হিসেবে দুই কোটি ৫২ লাখ ২০ হাজার। বর্তমানে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি একলাফে বেড়েছে ৩৪ টাকা, যা শতাংশের হিসাবে প্রায় ৪২ শতাংশ। ব্রি’র হিসাবে বিঘাপ্রতি জমিতে সেচ ও চাষ দিতে দরকার পড়ে ২০ লিটার ডিজেল। ডিজেলের দাম বাড়ায় এ বছর সেচে কৃষকের বিঘাপ্রতি খরচ পড়বে ৬৮০ টাকা। পাশাপাশি মাড়াই, পরিবহনের কাজেও ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রেও খরচ বাড়বে বিঘাপ্রতি ৩৫০-৪০০ টাকা। ফলে বিঘাপ্রতি এক হাজার টাকারও বেশি অতিরিক্ত খরচ পড়বে। শুধু বোরো মৌসুমে ৩ কোটি ২ লাখ বিঘা জমির জন্য কৃষকের জ্বালানি তেল বাবদ অতিরিক্ত খরচ হবে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তাছাড়া ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়ায় চলতি আমন ও পরবর্তী বোরো মৌসুমে চাল উৎপাদনে কৃষকের এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ বাড়বে। চলতি মৌসুমে ৫৯ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মধ্যে ৩৭ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। শতকরা হিসাবে ৬৮ শতাংশের কিছু বেশি জমিতে আমন রোপণ হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এবার আমন আবাদের হার ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশের বেশি নয়। জুলাইয়ের শুরু থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত আমন মৌসুম। আমন ধানের চারা রোপণের সময় মধ্য জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। এবার আমনের আবাদ এক মাসেরও বেশি সময় দেরি হয়েছে। আষাঢ়-শ্রাবণ বয়ে গেলেও বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষক ধান রোপণ করতে পারেনি। অনেক বীজতলা শুকিয়ে নষ্ট হয়েছে। আর আমন ধান পাকতে দেরি হলে পিছিয়ে যাবে আলু, সয়াবিন, সরিষাসহ রবিশস্য। ধান ও রবিশস্যের চক্র ব্যাহত হলে বেসামাল হয়ে পড়তে পারে গ্রামীণ অর্থনীতি। গত বছর সারা দেশে ৫৬ লাখ ২১ হাজার ৯৪৯ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছিল। উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ ৫৪ হাজার ৮৭২ টন। চলতি বছর ৫৯ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৫৪ লাখ টন উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু অনাবৃষ্টি এবং সার ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এবার ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হতে পারে। তাতে ৫০ লাখ টনেরও বেশি উৎপাদন ঘাটতি হতে পারে। ওই ঘটতি পূরণ করতে সরকারকে চাল আমদানি করতে হবে। বর্তমানে ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে চাল আমদানিতে সরকারকে কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যায় করতে হবে। তাছাড়া বিশ্বের প্রায় সব দেশে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। ফলে চাল আমদানি সম্ভব হবে কিনা তাও সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সূত্র আরো জানায়, দেশে গত বছর প্রায় ৬ লাখ ১০ হাজার টন চালের ঘাটতি ছিল। প্রতিকূল পরিস্থিতি, বিশেষ করে জলবায়ুর পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব, প্রতিকূল আবহাওয়া, উৎপাদন উপকরণের সঙ্কটসহ নানা ধরনের বিপর্যয় বিবেচনায় নিলে চলতি অর্থ বছরে তা ৮ লাখ টনের বেশি হবে। তাছাড়া ২০৩০ সালে চালের ঘাটতি হবে ৩৬ লাখ ২০ হাজার টন। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতি বা বিপর্যয়ে না পড়লে চালের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হতে পারে দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছিল। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টন হবে। অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন ১২ লাখ টন কমতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করর্পোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪১৩টি সেচযন্ত্র ছিল। তার মধ্যে ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৫০৭টি সেচযন্ত্র ডিজেলে চলেছে। অর্থাৎ ডিজেলে চলে প্রায় ৭৮.৪৩ শতাংশ সেচযন্ত্র। তার পাশাপাশি কৃষিযন্ত্র এবং পরিবহনে ডিজেলের ব্যবহার বেশি। ওই হিসাবে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৫৩৯ টন। ওই তেল কিনতে কৃষককে খরচ করতে হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। নতুন দামে আগামী বোরো মৌসুমে একই পরিমাণ ডিজেল ব্যবহৃত হলে কৃষককে গুনতে হবে ১১ হাজার ১২১ কোটি টাকা। ফলে সেচ, পরিবহন আর কৃষিযন্ত্র পরিচালন করতে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে ৩ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। তাছাড়া ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়ায় চলতি আমন ও পরবর্তী বোরো মৌসুমে চাল উৎপাদনে কৃষকের ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ বাড়বে। এদিকে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক আমন উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বেশি। গ্রামগঞ্জে বেশিভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। সেচ সংকট তৈরি হয়েছে। আবার বন্যার কারণে অনেক জায়গায় আমন ধান দেরিতে লাগানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সেচের অভাবে ধানক্ষেত ফেটে চৌচির। সেজন্য আমন নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা হয়েছে। আর আবহাওয়া বিভাগ বলছে, গত ৪০ বছরের মধ্যে এ বছর সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে একই পরিস্থিতি। ফলে সেচ দিয়ে ধানচাষ করতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় সেচের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হবে।