দিঘলিয়া (খুলনা) প্রতিনিধি ॥ বিবেচনায় কিশোর গ্যাং বর্তমান সময়ে ভয়ানক এক আতঙ্কের নাম। এই কিশোররা প্রচলিত সমাজের মধ্যে নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর অপরাধের সংখ্যা অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়েই চলেছে। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, সিগারেট খাওয়া, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, এলাকায় নেশা দ্রব্য আমদানি ও বেচা কেনার আধিপত্য, প্রভাব বিস্তারের জেরে হরহামেশা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, মারধর, দল বেধে হামলা, এমন কি বাড়ির ভেতরে ঢুকে পিতা-মাতার সামনে থেকে তুলে নিতেও দ্বিধা করছে না কথিত গ্যাং সদস্যরা।
এ সকল কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বিশ্লেষণে জানা গেছে, সাধারণত ছোট অপরাধ থেকে তাদের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে ইভটিজিং বা বখাটেপনা করলেও পরবর্তীতে খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কেনা-বেচা, ধর্ষণের মতো নৃশংস ঘটনায় নিজেদেরকে উদ্ভাবন করছে কিশোররা। এমনকি দল বেঁধে বিরোধী পক্ষের ওপরও হামলা করছে তারা। গত কয়েক বছর ধরে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হচ্ছে কিশোর গ্যাং । অপসংস্কৃতির বাঁধ ভাঙা জোয়ারও এজন্য অনেকাংশে দায়ী।
অর্থের বিনিময়ে অর্থদাতার প্রতিপক্ষের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে উঠতি বয়সী ছেলেরা। এমনকি সামান্য অর্থের বিনিময়ে খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়ছে তারা। গত ২৫ আগষ্ট বেলা ১টার সেনহাটি মসজিদ পাড়ার রতনের কিশোর পুত্র বাবুকে পুর্ব শত্রুতার জের ধরে পিছন থেকে ধাওয়া দিয়ে ধারালো রাম দা দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম করে। ঐ দিনে সেনহাটি পুলিশ ফাঁড়ির সামনের সুমন, আবুজর, জীবন, ইয়াসিন, নাসিরগং জয় নামে এক কিশোরকে ধারালো ছুরি ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। অভিযোগ রয়েছে, বিশেষ করে সমাজের বড় ভাই বা বস পরিচিতি পেতে এসব কিশোর বা উঠতি বয়সী তরুণকে নানা অনৈতিক কাজে ব্যবহার করছে স্থানীয় সমাজের এক শ্রেণির ব্যক্তি। এরা নিত্য নতুন অভিনব হেয়ার স্টাইল করে পাড়া, মহল্লা, অলিগলি ও ফুটপাতে জমিয়ে আড্ডা দেয়। সম্প্রতি টিকটক, লাইকির মতো ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহারে ঝুঁকেতে পড়ছেন কিশোর-তরুণরা। পাশাপাশি মোবাইলে ফ্রি ফায়ার, পাবজি ও টাকা দিয়ে লুডুর নামে জুয়া খেলা। এক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গ্যাং। উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ে জড়িতদের অধিকাংশই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। এসব চক্রের সদস্যদের বড় অংশ কিশোর হলেও নেতাদের বয়স ১৯ থেকে ৩৮ বছর। তাঁদের ‘সিনিয়র’ বা ‘বড় ভাই’ বলে ডাকে চক্রের সদস্যরা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব চক্রের নেতাদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন একটি মহলের সঙ্গে যুক্ত অথবা তাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার প্রায় প্রতিটি অস্থায়ী চায়ের দোকানে স্কুল-কলেজ ছুটির সময়ে কিশোরদের আড্ডাবাজি চলছে। রাস্তার সাথে দোকান হওয়ায় চলাচলরত স্কুল ছাত্রীদের ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। এদের কারো কারো আছে আবার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। শুধু চায়ের দোকান নয়, এমন চিত্র দেখা গেছে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, খেয়া ঘাট -লঞ্চ ঘাট, কলেজরোড, বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে। স্থানীয় কয়েকজন অভিভাবক বলেন, প্রায় সময়ই কিছু কিশোর এলাকার বিভিন্ন দোকানের সামনে দলবদ্ধ হয়ে বসে থাকে। যখনই কোন স্কুলছাত্রী বা মেয়ে আসে তখনই তারা নানা ধরনের অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করতে থাকে এবং ওই ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে ইভটিজিং করতে থাকে। ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস পায়না।
সাধারণ মানুষের অসহায় এ অবস্থা থেকে মুক্তি না মিললে সমাজে বাস করাই দায় হবে। কিশোর গ্যাংদের অপতৎপরতা প্রতিরোধে এরই মধ্যে উপজেলায় দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর অপরাধীদের তালিকা করা হচ্ছে বলে সুত্রে জানা যায়। তালিকা ধরে খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং, ছিনতাইসহ বড় অপরাধে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। অনেকের মতে, পারিবারিক শিক্ষার অভাব এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। আবার মাদক বিক্রেতা থেকে শুরু করে কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। এ সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।