খুলনা প্রতিনিধি ॥ অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় পাল ও বর্মণ রাজারা শাসন করেন বুড়নদ্বীপ। তাঁদের আমলে সভ্যতা, সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি ইতিহাস খ্যাতি লাভ করেছে বৌদ্ধ ইতিহাস ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি নামে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী পাল আমলে দশম শতকে দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাজা ছিলেন চন্দ্র বংশের রাজা ত্রৈলক্য চন্দ্র ও শ্রী চন্দ্র (৯৩০-৯৫৭)। চন্দ্র রাজের সময় দক্ষিণ বঙ্গ ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চন্দ্রবংশের নৃপতিরা বেশ কিছুকাল জনপ্রিয় শাসক ছিলেন এ জনপদে। শ্রী চন্দ্রের পর কল্যাণ চন্দ্র (৯৭৫-১০০৩ খ্রিঃ), লড়হচন্দ্র (১০০০-১০২০ খ্রিঃ), তার পরবর্তী রাজা গোবিন্দ চন্দ্র (১০২০-১০৪৫খ্রিঃ)। চন্দ্র বংশের সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী রাজা হিসেবে গোবিন্দ চন্দ্র ইতিহাস খ্যাত। তিনি চোল রাজ রাজেন্দ্র চোলের কাছে পরাজিত হলে দক্ষিণ অঞ্চলের শাসন ভার চলে যায় পাল বংশের হাতে। একাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পাল রাজারা দাপটের সাথে দক্ষিণ অঞ্চলে নিজেদের শাসন কাজ পরিচালনা করেন মহীপাল (৯৯৫-১০৪৫), তৃতীয় বিগ্রহ পাল (১০৫৮-১০৭৫), দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০খ্রিঃ), রামপাল (১০৮২-১১২৪ খ্রিঃ) প্রমুখ। পাল রাজাগণ ছিলেন ইতিহাস খ্যাত নৃপতি। ইতিহাস খ্যাত কৈবতর্ক বিদ্রোহ হয়েছিল একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। রামপাল এ সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। কৈবর্ত বিদ্রোহের ফলে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে উত্থান ঘটে বর্মদের। এ বংশের খ্যাত পুরুষ ব্রজবর্ম। পরে তাঁর পুত্র জাতবর্ম বহু যুদ্ধে জয়লাভ করে সার্বভৌমত্ব অর্জন করেন। কলচুরি রাজকর্ণের একখানি শিলালিপিতে (১০৪৮-১০৪৯ খ্রিঃ) উল্লিখিত আছে জাতবর্ম খুলনা জেলাসহ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্র বংশের রাজাকে ধ্বংস করেন। জাতবর্ম কেবলমাত্র নিজের বাহুবলে অঙ্গ কামরূপ ও বরেন্দ্রে স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করে খুলনা জেলাসহ দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বর্ম বংশের অপরাপর শাসকরা হলেন-হরিবর্ম, সালবর্ম, ভোজবর্ম প্রমুখ। বঙ্গে বর্ম পরবর্তী রাজত্ব শুরু সেন বংশের। সেন বংশের আবির্ভাব সম্পর্কে ইতিহাস দৃঢ় কোন তথ্য দিতে পারে না। এ বংশের তৃতীয় নৃপতি বিজয় সেনের আমলটি খ্যাত একটি সময়। তাঁর শাসনামল ছিল ১০৯৭ থেকে ১১৬০ খ্রিঃ পর্যন্ত। তিনি খণ্ড বিভাজন শোষণ ব্যবস্থার আওতায় এনে প্রচলন করেছিলেন কেন্দ্রীয় শাসন। বিজয় সেন ছিলেন শৈব। এছাড়া সেন আমলের যে শিলালিপি ও ফলক পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায় এঁরা ছিলেন চন্দ্র বংশীয় ব্রহ্ম ও ক্ষত্রিয়। বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮ খ্রিঃ) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বাগড়ি নামক এলাকায় প্রশাসনিক বিভাগ সুদৃঢ় করেন। বাগড়ি অঞ্চলের পরিচয় ও উৎপত্তি বিষয়ে জানা যায়- “উপবঙ্গ নদী ও জঙ্গলে সমাচ্ছন্ন ছিল। বোধ হয় বাগুরি বা বাউরি জাতির নামানুসারে বাগড়ি নাম হইয়াছে। উপবঙ্গের গঠন-কালে বারংবার আগ্রেয় উৎপাত ঘটিয়াছিল। কলিকাতা অঞ্চল খনন করিয়া দেখা গিয়াছে, সে প্রদেশের অরণ্য, অরণ্য-জন্তুসহ বারংবার বসিয়া গিয়াছিল। বঙ্গ ও উপবঙ্গ, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাদ (মেঘনা) ও গঙ্গার ব-দ্বীপে গঠিত। রাঢ়, বরেন্দ্র, বঙ্গ ও মিথিলা পূর্ব হইতেই ধন-জন-পরিপূর্ণ ছিল; কিন্তু বাগড়িতে মনুষ্যের বাস ছিল না। এই স্থান সমূদ্র গর্ভ হইতে মস্তক উত্তোলন করিতেছিল। আকবরনামায় ইহার ভাটিনাম দেখা যায়। বাগড়ির দৈর্ঘ্য ৫৫০ মাইল ও বিস্তার ৩১২ মাইল। পূর্ব-বিক্রমপুর পদ্মার দক্ষিণে ছিল; যখন ধলেশ্বরী দিয়া পদ্মা প্রবাহিত হইত, অতএব বিক্রমপুর পূর্বে বাগড়ির অন্তর্গত ছিল। এখন ইহা বঙ্গের অন্তর্গত হইয়াছে। বাগড়ির এই অংশই প্রাচীন সমতট”। রজনীকান্ত বাগড়ি অঞ্চলের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে তিনি এ অঞ্চলকে মোট ১০টি ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো- ১. অন্ধ্রদ্বীপ ২. সূর্যদ্বীপ ৩. মধ্যদ্বীপ ৪. জয়দ্বীপ ৫. চক্রদ্বীপ ৬. কুশদ্বীপ ৭. এডুদ্বীপ ৮. প্রবালদ্বীপ ৯. চন্দ্রদ্বীপ ১০. বৃদ্ধদ্বীপ। বল্লাল সেন ছিলেন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। বৃদ্ধ বয়সে তিনি পুত্র লক্ষ্মণ সেনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে মহাদীক্ষায় দীক্ষিত হন। অদ্ভুতসাগর এর একটি তথ্যানুযায়ী বল্লাল সেন শেষ বয়সে সস্ত্রীক ত্রিবেনীর নিকট গঙ্গা তীরে বানপ্রস্ত অবলম্বন করে অতিবাহিত করেছিলেন। এর অন্য অর্থও করা যায় যে, বৃদ্ধ রাজা ও রাণী স্বেচ্ছায় গঙ্গাগর্ভে দেহত্যাগ করেছিলেন।