খুলনা প্রতিনিধি ॥ লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বের শেষ আমলে রাজ্যে দেখা যায় নানা রকম অরাজকতা। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বলতে গেলে কোন রকম বাধা ছাড়াই অধিকার করেন বাংলা। এ ঘটনার পরও প্রায় দ্ ুবছর জীবিত ছিলেন লক্ষণ সেন। বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণের পর তিনি নদীয়া থেকে নৌকাযোগে পালিয়ে যায় বিক্রমপুরে। স্থানীয় প্রভাবশালী কোমল পাল নামে একজন নৃপতি লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে খুব সম্ভবত খুলনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অধিকার করেন। বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের সূত্র ধরেই বাংলায় মুসলিম রাজত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়। তবে এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন সুদৃঢ় হতে আরো একশত বছরের মতো সময় লাগে। বখতিয়ার পরবর্তী শাসক আল মর্দান খিলজী (১২১০-১২১২খ্রিঃ) ও গিয়াসউদ্দিন ইওজ খিলজী (১২১২-২৭ খ্রিঃ) দু’শাসকই কর গ্রহণ করতেন রাজাদের কাছ থেকে। ফলে বলা যায় এ সময় পর্যন্ত সাতক্ষীরা-খুলনা অঞ্চল পুরোপুরি মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এর পরের ২৮ বছর (১২২৭-১২৫৫ খ্রিঃ) এ অঞ্চলের ইতিহাস কোলাহলপূর্ণ। কিছুদিন সমগ্র বাংলা পরিণত হয় একটা প্রদেশে, আবার মুগিসউদ্দীন ইওজবেক এর নেতৃত্বে বাংলা ভোগ করে স্বাধীনতা। গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসনামলে সুন্দরবনসহ বেশ কিছু অঞ্চল তাঁর অধিকারে আসে। তিনি প্রথমে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা আক্রমণ করে অধিকার করেন এবং সোনারগাঁও অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। এ সময়ে চন্দ্রদ্বীপের (বরিশাল) রাজা ছিলেন কায়স্থ নৃপতি দশরথ দনুজমর্দন দেব। বুঘরা খান (১২৮১-১২৮৭ খিঃ) রুকনউদ্দিন কায়কাউস (১৩০০ খ্র্র্রিঃ) এর সময়ে সাতক্ষীরা অঞ্চল তাঁদের অধিকারে ছিল কিনা তার সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা জয় করেন। ফলে বলা যায় সাতক্ষীরা অঞ্চল তাঁর রাজ্যসীমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন শাসসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। তাঁর সময় থেকে সাতক্ষীরা অঞ্চল চলে যায় শাহী বংশের অধীনে। ১৩৯৯ থেকে ১৪১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাতক্ষীরা অঞ্চল ছিল ইলিয়াস শাহের বংশের অধীনে। ১৪১২-১৪৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সিংহাসন অর্ন্তদ্বন্দ্বে পূর্ণ। ১৪৪২ সালে শাহীবংশের নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ সিংহাসনে বসেন। দক্ষিণ বঙ্গের মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে যিনি খ্যাত তিনি খানজাহান আলী। এই দরবেশ সেনা দক্ষিণবঙ্গ জয় করেন ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে। কথিত আছে যে, তিনি বাংলার সুলতান নাসিরউদ্দিন শাহের নিকট থেকে একটি সনদে সুন্দরবন থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার করে জনপদ সৃষ্টি করার অধিকার লাভ করেন। নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের পরবর্তী সময়ে হোসেন শাহী নসরত শাহের সময়েও সাতক্ষীরা ছিল তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। কররানী বংশ প্রতিষ্ঠত হয় ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে। নানা কারণে এ বংশের শাসকেরা ইতিহাসে বিখ্যাত। কররানী বংশের পারিবারিক দ্বন্দ্ব ইতিহাসের আলোচিত অধ্যায়। তাজখান এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাসক। তাজখান, তার ভ্রাতা সুলেমান খানের রাজত্বকালে তেমন উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য না থাকলেও সুলেমান খানের দ্বিতীয় পুত্র দাউদখান কররানী এ বংশের আলোচিত শাসক। মাত্র তিন বছরের শাসনামলে (১৫৭৩-১৫৭৬ খ্রিঃ) তিনি অনেক নিকট আত্মীয়কে হত্যা করেন। ঘোড়শ শতকের শেষের দিকে বাংলায় আবির্ভাব হয় বারো ভূঁইয়াদের। কররানী বংশের পতনের পর দক্ষিণাঞ্চলের ভূঁইয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে শ্রীহরি নামের এক ব্রাহ্মণের। তিনি ছিলেন দাউদ কররানীর প্রধান পরামর্শদাতা। শ্রীহরি সুন্দরবন অভ্যন্তরে মকুন্দপুর নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন ও বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেন। পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় ধুমঘাট। তাঁর মুত্যুর পর পুত্র প্রতাপাদিত্য রাজ্য সম্প্রসারণে সচেষ্ঠ হন। তিনি কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। প্রতাপাদিত্য ছিলেন সমৃদ্ধশালী ও ক্ষমতাঘর শাসক। বাংলার জমিদারদের মধ্যে প্রতাপাদিত্যই সর্বপ্রথম মুঘলদের আনুকুল্য লাভের জন্য ইসলাম খান এর নিকট দূত প্রেরণ করেন এবং পরে ব্যক্তিগতভাবে মুবহদার এর নিকট আনুগত্য প্রদর্শন করেন। পরে প্রতিশ্র“তি ভাঙার কারণে প্রতাপ বাহিনীর সাথে দুটো যুদ্ধ হয় মোঘল বাহিনীর। প্রথম যুদ্ধটি হয় সালকা নামক স্থানে ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে। এ যুদ্ধে প্রতাপের পক্ষে নেতৃত্ব দেন তাঁর জৌষ্ঠপুত্র উদয়াদিত্য ও মোঘলবাহিনীর পক্ষে নেত্রত্ব দেন জামাল খান। মোঘল বাহিনীর সাথে প্রতাপাদিত্যের দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় কাগারঘাট ও যমুনার সঙ্গমস্থলে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। এ যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন গিয়াস খানের কিনট। তাঁর শেষ জীবন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। ‘মোঘল বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার পর সম্ভবত বন্দি অবস্থায় দিল্লি যাওয়ার পথে বেনারসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন’। প্রতাপাদিত্যের পতনের পর খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চল চলে যায় জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে। খান-ই-আজম মির্জা আজিজ কোকা (১৮৮২-১৮৮৩ খ্রিঃ) প্রতাপের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের পুরস্কারস্বরূপ মোঘলদের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন আমিদপুর, সৈয়দপুর, মুগদাগাছা ও মল্লিকপুরের জমিদারি। এ সময়ে দক্ষিণাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য অপরাপর জমিদাররা হলেন ভবেশ্বর রায়, মাহতাব রায় (১৫৮৮-১৬১৯ খ্রিঃ), কন্দর্প রায়, মনোহর রায় (১৬৪০-১৭০৫ খ্রিঃ) ও শ্রীকৃষ্ণ রায় (১৭০৫-১৭৭২ খ্রিঃ)। সুন্দরবন, সাতক্ষীরা অঞ্চলে প্রতাপাদিত্যের পর ব্যাপক প্রশাসনিক উন্নতি হয় হেংকেলের আন্তরিকতায়। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে টিলম্যান হেংকেল প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ নিযুক্ত হন যশোর অঞ্চলে। ঐ বছরেই যশোরে প্রথম আদালত স্থাপিত হয়। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি খুঁটি দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করেন। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে যশোর পৃথক জেলার মর্যাদা পায়। এরপর থেকে যশোর অঞ্চল।