সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:১৫ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::
শুল্কমুক্ত সুবিধায় হাজার হাজার টন চাল আমদানিতেও বাজারে প্রভাব পড়েনি বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ শীতজনিত রোগীর চাপ রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি হাসপাতালে বাড়ছে সাতক্ষীরা পৌর—মেয়রের বরখাস্তের আদেশ অবৈধ: হাইকোর্ট স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রেনে কাটা পড়ে শিশুর মৃত্যু সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জে দুই পক্ষের সংঘর্ষে বিএনপি নেতা নিহত মোবাইল—ইন্টারনেটে কর প্রত্যাহার না হলে এনবিআর ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি ভারত থেকে এলো ২৭ হাজার মেট্রিক টন চাল টিউলিপের উচিত ক্ষমা চাওয়া: ইউনূস বিজিবি—জনগণ ‘শক্ত অবস্থান’ নেওয়ায় ভারত পিছু হটেছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

খুলনা বিভাগের ইতিহাস ঐতিহ্য (৩৫)

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৩

নড়াইল জেলার ইতিহাস
সিরাজুল ইসলাম খুলনা থেকে ॥ ১৮৬১ সালে যশোর জেলার অধীন নড়াইল মহাকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। নড়াইল শব্দটি স্থানীয় লোকমুখে নড়াল নামে উচ্চারিত হয়। ঐ সময় নড়াইল সদর, লোহাগড়া ও কালিয়া থানার সমন্বয়ে এই মহাকুমা গঠিত হয়। পরবর্তীতে আলফাডাঙ্গা থানা এবং অভয়নগর থানা এই মহাকুমা ভুক্ত হয়। ১৯৩৪ সালে প্রশাসনিক সীমানা পূর্নগঠনের সময় অভয়নগরের পেড়লী, বিছালী ও শেখহাটি এই তিনটি ইউনিয়নকে নড়াইল জেলা ভুক্ত করে অবশিষ্ট অভয়নগর যশোর জেলা ভুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় এই মহাকুমায় চারটি থানা ছিল। ১৯৬০ সালে আলফাডাঙ্গা থানা যশোর হতে ফরিদপুর জেলা ভুক্ত হয়। ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ নড়াইল মহাকুমাকে জেলায় রুপান্তরিত করা হয়। প্রথম জেলা প্রশসাক ছিলেন ম শাফায়াত আলী। ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ নড়াইল মহকুমার প্রশাসক জনাব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর নেতৃত্বে অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ, জনাব আব্দুল হাই এবং অন্যান্যদের সহযোগিতায় নড়াইল ট্রেজারীর তালা ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে যশোর সেনানিবাস আক্রমণের মধ্যে দিয়ে এ জেলার মানুষের মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়। অগণিত মুক্তিযোদ্ধার রক্ত এবং অনেক অত্যাচারিত, লাঞ্চিত মা-বোনদের অশ্রু ও সংগ্রামের ফলে ১৯৭১ সনের ১০ ডিসেম্বর নড়াইল হানাদার মুক্ত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে নড়াইল জেলার বিশেষ অবদান রয়েছে। নড়াইল জেলা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুক্তিযোদ্ধা অধ্যুষিত জেলা। এ জেলা হতে প্রায় ২০০০ জন মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। দেশের ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠর একজন মরহুম ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ নড়াইলের কৃতি সন্তান। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শাহাদাৎ বরণকারীর সংখ্যাও একেবারে কম নয়। পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক চিত্রা নদীর পাড়ে লঞ্চঘাটের পল্টুনের উপর ২৮০০ লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। নামকরণের বিষয় কথিত আছে। বাংলার সুবাদার আলিবর্দি খানের শাসন আমলে দেশের বিভিন্ন অংশে বর্গি ও পাঠান বিদ্রোহীরা নানা ধরনের উৎপীড়ন শুরু করে। আলিবর্দির মুঘল বাহিনী বর্গি ও পাঠানদের সম্পূর্ণ শায়েস্তা করতে ব্যর্থ হন। এরপর বর্গি ও পাঠান দস্যুরা তাদের অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। সুবা বাংলার পশ্চিম ও উত্তর অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রাণভয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকায় পালাতে থাকে। সেই সময় মদনগোপাল দত্ত নামে সুবাদারের এক কর্মচারী কিসমাত কুড়িগ্রামে সপরিবারে নৌকা যোগে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি কচুড়ির শক্ত ধাপের উপর একজন ফকিরকে যোগাসনে উপবিষ্ট দেখতে পান। উক্ত ফকির দত্ত মশাইয়ের প্রার্থনায় তার নড়িটি (লাঠি) দান করেন এবং এই নড়ি পরবর্তীতে আশীর্বাদ হয়ে দাড়ায়। মদনগোপাল দত্ত ফকির বা সাধক আউলিয়ার নড়ি বা লাঠি পেয়ে ধীরে ধীরে প্রতিপত্তি অর্জন করেন। এই ভাবে কিসমাত কুড়িগ্রাম অঞ্চলের ঐ স্থানের নাম হলো নড়াল। নড়ালের লেখ্য রূপ হলো নড়াইল। স্থানটি নড়িয়াল ফকিরের নড়ি থেকে পরিচিতি লাভ করে। মদনগোপাল দত্তের পৌত্র বিখ্যাত রূপরাম দ্ত্ত। রূপরাম দত্তই নড়াইলের জমিদারদের প্রথম পুরুষ। যা হোক, মদনগোপাল দত্ত ও তার উত্তরাধিকারীরা নড়িয়াল ফকিরের অতি শ্রদ্ধাবশত নড়াল নামটি স্থায়ী করেন। তারা কোনো পরিবর্তন আনেননি। নড়াইলে নীলবিদ্রোহের কারণে মহকুমা স্থাপনের প্রয়োজন হলে ১৮৬৩ সালে ইংরেজ সরকার মহিশখোলা মৌজায় মহকুমার প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। এইভাবে মুঘল আমলের ’নড়াল’ নামটি ইংরেজ শাসনামলে নড়াইল নামে পরিচিতি পায়। কিসমাত কুড়িগ্রাম বা কুড়িগ্রাম নড়াইল বা নড়ালগ্রাম হতে প্রাচীন। কিসমাত কুড়িগ্রামে মুঘল শাসনামলের পূর্বে সুলতানি শাসনামলে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ও সেনাছাউনি ছিল। কিসমাত কুড়িগ্রামের আয়তন ও ছিল বেশ বিস্তৃত। গবেষক এস,এম রইস উদ্দীন আহমদ এর মতে লড়েআল হতে নড়াইল নামের উৎপত্তি হয়েছে। যারা শক্রর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্থানীয় ভাষায় তাদের লড়ে বলে। হযরত খান জাহান আলীর সময়ে রাজ্যের সীমান্তে সীমান্ত প্রহরী নিয়োজিত ছিল। নড়াইল এলাকা নদী নালা খাল বিল বেষ্টিত। খাল কেটে রাজ্যের সীমান্তে পরীখা তৈরী করা হত। খাল বা পরীখার পাশে চওড়া উচু আইলের উপর দাড়িয়ে লড়ে বা রক্ষী সেনারা পাহারা দিত। এভাবে লড়েআল হতে লড়াল> নড়াইল নাম এর উৎপত্তি হয়েছে বলে জনশ্র“তি আছে। আরেকটি প্রচলিত মত হল নড়ানো থেকে নড়াইল নামের উৎপত্তি হয়েছে। বাংলাদেশে অনেক স্থানের নামের সাথে ইল প্রত্যয় যুক্ত আছে যেমন টাঙ্গাইল, ঘাটাইল, বাসাইল, নান্দাইল ইত্যাদি। প্রত্যোকটি সহানের নামকরণের ক্ষেত্রে কিছু কিংবদন্তী বা লোক কাহিনী প্রচলিত আছে। একটি বড় পাথর সরানোকে কেন্দ্র করে নড়াল বা নড়াইল নামের উৎপত্তি বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে বাংলাপিডিয়া এবং কতিপয় লেখকদের বিভিন্ন লেখা থেকে নামকরনের ইতিহাস যা পাওয়া গেছে সেটা এরকমঃ- “নড়াইল জেলার নামকরণ : ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে আনুমানিক ১০ লক্ষ বৎসর পূর্বে গঙ্গা নদী প্রবাহিত পলিমাটি দ্বারা গাঙ্গেয় বদ্বীপ সৃষ্টি হয়। সমগ্র বঙ্গে নড়াইল জেলা ও দক্ষিণ বঙ্গের ব-দ্বীপের অন্তর্গত এক ভূখন্ড।” নড়াইল নামের কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কিংবদন্তী আছে যে হযরত খানজাহান আলী (রা:) দক্ষিণ বঙ্গে ইসলাম প্রচার করতে এসে খলিফাতাবাদ রাজ্য স্থাপন করেছিলেন এবং রাজধানী স্থাপন করেছিলেন বাগেরহাটে। বাগেরহাটে তার মাজার আছে। খলীফাতাবাদ রাজ্যের সীমানা বা আয়তন কতটুকু ছিল তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকের মতে, খলিফাতাবাদ রাজ্যের উত্তর অংশের সীমান্ত ছিল আজকের নড়াইল এলাকা। এ রাজ্যের সীমান্ত প্রহরী ছিল। সীমান্ত রক্ষীরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। তাই লোকে তাদেরকে “লড়ে” বলত। “লড়ে” একটি আঞ্চলিক শব্দ। “লড়ে” শব্দটিকে সাধারণ মানুষ বুঝতো – যারা লড়াই করে। আর নড়াইল এলাকা হযরত খানজাহান আলী (রা:) এর সময় খাল-বিল ও নদী নালায় ভরপুর ছিল। তাই লড়েরা উঁচু আইল তৈরী করে তার ওপর দিয়ে সীমান্ত পাহারা দিতো। লোকে এই আইলকে নাম দিয়েছিল “লড়ে আল”। পরবর্তী সময়ে ‘লড়ে আল’ থেকে নড়াইল নাম হয়েছে। আর লড়েরা সেখানে এক পর্যায়ে বসবাস শুরু করে এবং সেখানে গ্রাম গড়ে ওঠে। লোকে গ্রামের নাম দেয় ‘লড়ে গাতী’। গাতি শব্দের অর্থ গ্রাম। ‘লড়েগাতি’ পরবর্তী সময়ে ‘নড়াগাতি’ হয়েছে। কালিয়া উপজেলায় ‘নড়াগাতি’ অবস্থিত (বর্তমানে একটি নতুন থানা)। নড়াগাতির পাশে যে নদী ছিল তারও নাম হয়েছিল ‘লড়াগাতী নদী’। পরবর্তীতে নাম হয় ‘নড়াগাতী নদী’। নড়াগাতী নামে একটি বন্দরও ছিল। বর্তমানে নড়াগাতিতে একটি বাজার আছে। তাই ‘লড়া আইল’ থেকে ‘নড়াইল’ নাম হবার ব্যাপারে অনেকেই সমর্থন করেছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com