পেশা ভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতি
খুলনা প্রতিনিধি ॥ গোটা জাতির প্রাণ স্পন্দনকে ধারণ করে লোকজ সংস্কৃতি। আমাদের জাতীয় সত্তাকে ধারণ করেই লোকজ সংস্কৃতি বেড়ে ওঠেছে। প্রখ্যাত লোক বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড.ওয়াকিল আহমেদ বলেছেন, ‘দেশাচার, লোক প্রথা প্রচলিত বিধি ব্যবস্থা যা তা পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে দেখে-শুনে লাভ করে, তাই লোক সংস্কৃতির সম্পদ। অর্থাৎ লোক সংস্কৃতি প্রধানতঃ ঐতিহাসিক। পৈতৃক সম্পতির মতো এগুলো বিনা দ্বিধায়, বিনা বিচারে গ্রহণ করেও পালন করে। গভীর অনুধ্যান ও অনুশীলন নেই বলে লোক ভাবনার দ্বারা নতুন উদ্ভাবন সম্ভব হয় না। লোক সংস্কৃতি স্থুলতা ও অশালীনতার কারণে এর নন্দনতত্তের আবেদন তেমন হৃদয়গ্রাহী হয় না। ব্যবহারিক প্রয়োজন, নিরপেক্ষ অভ্যাস ও আচারণ লোক সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য দেখা যায় না। লোক সংস্কৃতি মননশীল নয়। এতে স্বভাব ও প্রবৃত্তির ছাপ বেশী পড়ে। এজন্য লোকসংস্কৃতি অকৃত্রিম সরলতা ও স্বাভাবিকতা লোক সংস্কৃতির ভূষণ। জনসাধারণের অক্ষর জ্ঞান নেই বলে তারা কোন কিছু গ্রন্থবদ্ধ করে রাখে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই লোক জ্ঞানের প্রধান উৎস। লোকমুখে তা প্রচালিত হয়, লোক শ্রুতিতে গৃহীত ও লোকস্মৃতিতে রক্ষিত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, তথা জাতিতত্ত্বের প্রকৃত উপাদান লোক সংস্কৃতিতে প্রবাহমান থাকে। সুতারাং একটি দেশের একটি জাতির মৌলিকতা ও স্বকীয়তার পরিচয় তার লোক সংস্কৃতির দ্বারাই সম্ভব’।
লোকজ সংস্কৃতি লৌকক মানুষের ভাব ও রসের জীবন্ত উৎস। লোকজ সংস্কৃতির মাঝ দিয়ে লৌকিক মানুষের পিয়াসী হৃদয়ের দুর্বার আকুলি-বিকুলি নানাভাবে প্রচারিত হয়েছে। লোক সংস্কৃতিতে লোক জীবনের ভক্ত পবিত্র অধ্যায়ের ভাবগম্ভীর সংহত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। বিচিত্র মনের বিচিত্র অনুভূতি অন্যান্য রূপ লাভ করেছে লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে। আমাদের দেশ গ্রামে গাথা। গ্রামই বাংলাদেশের জনজীবনের ও লোক সংস্কৃতির প্রাণ কোষ। গ্রামেই অধিকাংশ লোক বাস করে। তাই লোকসংস্কৃতি ও লোকজীবন নিয়ে পর্যালোচনা করতে হলে গ্রামকে অবশ্যই মূল্য দিতে হবে। আমাদের দেশে বৃত্তির দিক দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর লোক আছে। এর মধ্যে কৃষিকাজে জড়িত লোকের সংখ্যা বেশী। কৃষিজীবী মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে আছে- মাঝি-মাল্লা, জেলে, তাঁতী, কামার, কুমার, ছুতার, সেকরা, কাঁসারী, চুনারী, তেলী, মালী, ধোপা, গোয়ালা, ময়রা, কাহার, ঘরামী,টিুয়া, কাঠুরে, বারুই, বেদে, দর্জি, কবিরাজ, ওঁঝা, কসাই, নাপিত, ডোম, চামারসহ আরো অনেক পেশাজীবী মানুষ। এদের জীবনের বিভিন্ন দিক এক নয়। তাই এদের সাংস্কৃতিক জীবনও আলাদা। এর ফলে লোকজ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শ্রেণীতে সমৃদ্ধ হয়ে। আবার দেশের লোক সংস্কৃতি অঞ্চল ভিত্তিক আলাদা রূপ লক্ষ্য করা যায়। এদিক দিয়ে খুলনা জেলা সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। অন্যান্য জেলার মত খুলনা জেলার লোকজ সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। তাই এ জেলার গ্রাম-গঞ্জের মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। খুলনা জেলার পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পালকির গান, ওঝার গান, বাওয়ালীদের গান, গাছ কাটার গান, গাড়োয়ানের গান, জেলেদের গান, কবিরাজের গান, ঘোল তৈরীর গান, চুন তৈরীর গান, কুমারের গান, হাবু গান, ধান কাটার গান, ধুয়া গান ইত্যাদি। এছাড়া আছে তালের পাখা, শোলার খেলনা, বাঁশ ও বেতের পাত্র, মাটির পাত্র, পুতুল ও খেলনা, মাদুর, কাঠের খেলনা ইত্যাদি তৈরি কাজে নিয়োজিত পেশার মানুষের দ্বারা গড়ে ওঠা লোকজ সংস্কৃতি। পালকির গান : সুপ্রাচীন কাল থেকেই গ্রাম বাংলায় পালকির প্রচলন ছিল। পালকির ব্যবহার সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে ছিল। জমিদারদের আট বেহারা/ষোল বেহারায় পালকী এখন অতীত হয়ে আছে। কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে পালকীই ছিল অন্যতম প্রধান বাহন। বিয়ে-সাদীতে পালকী না হলে বিয়ের আমেজই পাওয়া যেতো না। পালকীর জন্যে অশনি সংকেত হয়ে এলো যান্ত্রিক যান এবং অন্যান্য বিকল্প বাহন। যান্ত্রিক যানের ব্যবহার যতো বাড়তে লাগলো, পালকীর সুসময় ততো নাগালের বাইরে যেতে লাগলো। কোথাও কোথাও পালকীর ব্যবহার থাকলেও তা সীমিত।