যশোরে মুসলমান যুগ
খুলনা প্রতিনিধি ॥ ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজীর নদীয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্য তখনো পর্যন্ত লক্ষণাবর্তীর চারপাশে কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখন্ডে সীমাবদ্ধ ছিল। সুতরাং কেবলমাত্র নদীয়া বিজয়ের সাথে সাথেই যশোর জেলা লক্ষণাবর্তীর মুসলমান শাসকদের অধীনে আসেনি। সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইত্তয়াজ খিলজি-ই (১২১৩-১২২৭) হচ্ছেন লক্ষণাবর্তীর প্রথম শাসক যিনি দক্ষিণ এবং পূর্বে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু তার শাসনামলেও যশোর জেলা লক্ষণাবর্তীর অন্তর্ভুক্ত হয়নি। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষার্ধে সুলতান মুঘিসুদ্দিন তুঘরালের (১২৬৮-১২৮১) শাসনামলে এ জেলা লক্ষণাবর্তী রাজ্যের অধীনে আসে। সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রিঃ) এর শাসনামলে যশোর জেলার উপর দিল্লীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। লক্ষণাবর্তী রাজ্যের গভর্ণর সুলতান মুঘিসুদ্দিন তুঘরাল ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ জেলা শাসন করেন। তিনি ছিলেন সর্বশেষ এবং সবচেয়ে মহান রাজা তিনি সামান্য ক্রীতদাস থেকে বাংলার সার্বভৌম ক্ষমতার আসনে আসীন হয়েছিলেন। কিন্তু তার জীবনের করুণ পরিণতি ঘটে। কারণ তিনি দিল্লীর শাসকবর্গের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। লক্ষণাবর্তী রাজ্যের উপর তার স্বাধীন শাসন খুব স্বল্প সময় স্থায়ী হয়েছিল। সুলতান মুঘিসুদ্দিন তুঘরল এর মৃত্যুর পর সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন এর পুত্র শাহজাদা নাসিরম্নদ্দিন মুহাম্মদ বুঘরা খান লক্ষণাবর্তীর গভর্ণর নিযুক্ত হন। তিনি ছয় বৎসর এ রাজ্য শাসন করেন। তার শাসনামল ছিল ১২৮১ থেকে ১২৮৭ খ্রিঃ পর্যন্ত। ১২৮৭ খ্রিঃ তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি সুলতান নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ উপাধি লাভ করেন। এ সময় থেকেই লক্ষণাবর্তী রাজ্যের স্বাধীন স্বত্তা দিল্লীর সালতানাতের স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। সেসময় থেকে ১২২৪ খ্রিঃ পর্যন্ত যশোর জেলা লক্ষণাবর্তীর শাসকদের অধীনে ছিল। ১৩২৪ খ্রিঃ সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক লক্ষণাবর্তীকে তার সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করেন এবং স্বাভাবিক কারণেই যশোর জেলা পুণরায় দিল্লীর সালতানাতের এর অধীনস্থ হয়ে পড়ে। মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বের শেষ সময়ে রাজ্যব্যাপী বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে তার কর্তৃত্ব ক্রমশ কমে আসতে শুরু করে। এসময় সমগ্র লক্ষণাবর্তী রাজ্য তিন খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফখরুদ্দিন, ইলিয়াস এবং আলীশাহ পৃথক পৃথকভাবে পূর্ব, দক্ষিণ এবং পশ্চিম অংশ শাসন করতেন। পরবর্তীতে ১৩৪২ খ্রিঃ ইলিয়াস শাহ যখন লক্ষণাবর্তীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তখন যশোর জেলা পুনরায় লক্ষণাবর্তীর অধীনে চলে যায়। এভাবে লক্ষণাবর্তীর সিংহাসনে ইলিয়াস শাহের আরোহণের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। তিনি শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি লাভ করেন। এটি ছিল হিজরি ৭৪৩ সন এবং ১৩৪২ খ্রিঃ এর ঘটনা। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সমগ্র মুসলিম বঙ্গকে একত্রিত করে একটি রাজতন্ত্রের অধীনে এনেছিলেন এবং ১৩৫৭ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সময় এ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। তার উত্তরসূরিগণ হলেন সিকান্দার শাহ (১৩৫৭-১৩৯২) গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯২-১৪১০) সাইফুদ্দিন হামজাহ শাহ (১৪১০-১৪১১ খ্রিঃ) শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ (১৪১২-১৪১৪) এবং আলাউদ্দিন ফিরোজশাহ (১৪১৪ থেকে রাজা গণেশের উত্থান পর্যন্ত সময়)। এসময় যশোর জেলা লক্ষণাবর্তী রাজ্যের অংশ হিসেবে তাদের দখলে ছিল। ১৪৮৭ সালে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন ঘটিয়ে দাস বংশ তাদের রাজত্ব শুরু করে। দাস রাজাগণ ১৪৯৩ খ্রিঃ পর্যন্ত এখানে তাদের অধিকার টিকিয়ে রাখেন। দাস বংশের পতনের পর যশোর সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এর শাসনাধীন চলে যায়। ১৫৩৮ খ্রিঃ পর্যন্ত হুসেন শাহী বংশ এ অঞ্চলে তাদের শাসনকাল বজায় রাখে।