বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৪১ পূর্বাহ্ন

গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ঢেঁকি নেই, নেই ঢেঁকিশাল, এখন শুধুই অতীতের গল্প

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

শাহজাহান সিরাজ, কয়রা (খুলনা) থেকে \ আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া রেগেছে প্রায় সবখানে। শহর থেকে গ্রাম অঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মান পাল্টে গেছে। মাটির স্থলে উঠেছে ইটের বাড়ী। কুড়েঘরের স্তান নিয়েছে দালানকোঠা। মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ করতে তৈরি করা হয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি, ব্যবহার হচ্ছে হারফিল সব প্রযুক্তি। এই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়কার গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। এক সময় গ্রামের প্রতিটি ঘরেই ঢেঁকির ব্যবহার লক্ষ্য করা যেত। গ্রামের প্রতিটি বাড়ীতে ছিল ঢেঁকিঘর। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ঢেঁকির ব্যবহার। আধুনিক যন্ত্রপাতি এর প্রযুক্তির আড়ালে চাপা পড়ে গেছেগ্রামের সেই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। সেই চিরচেনা সুর আজও কানে বাজে ওবউ ধান ভানেরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া ওবউ ধান ভানেরে” ঢেঁকির পাড়ে পল্লীবধুদের গান গ্রাম বাংলার গ্রামীণ জনপদে সবার মুখে শোনা গেলেও বর্তমান প্রজন্মের কাছে তা অকল্পনীয়। এ উক্তিটি প্রয়াত পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের। চিরাচরিত গ্রামবাংলার কৃষক পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের ব্যহৃত ঢেঁকি শিল্পকে নিয়ে রচিত। কিন্তু এই ঐতিহ্য এখন আর চোখে পড়ে না গ্রামাঞ্চল। সোনালী ফসলের এমন সময়ে আগেকার দিনে দেখা যেত গ্রামবাংলার বধুরা ঢেঁকি দিয়ে ধান ভানছেন। ঢেঁকি ছিল বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ঢেঁকি গৃহস্থের সচ্ছলতাও সুখ সমৃদ্ধির প্রতিক হিসেবে প্রচলিত ছিল। আমাদের এ প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকিশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। এক সময় প্রত্যেক গ্রামে প্রায় সব বাড়ীতেই ঢেঁকির প্রচলন ছিল। কিন্তু এখন এই ঢেঁকি দুষ্প্রাপ্য হয়ে আছে। গ্রামের অভাবগ্রস্থ মহিলাদের উপার্জনের প্রধান জীবিকার মাধ্যম ছিল এই ঢেঁকি। গ্রামের বিত্তশালীদের বাড়ীতে যখন নতুন ধান উঠত তখন অভাবগ্রস্থ মহিলারা ঢেঁকিতে ধান ছেটে চাউল বানিয়ে দিত। তা থেকে তারা যা পেত তা দিয়েই সংসার চলতো তাদের। এক সময়ে চাল আর আটা প্রস্তুতের এক মাধ্যম ছিল ঢেঁকি। নবান্ন এলেই ঢেঁকির পাড়ে ধুম পড়তো নতুন ধানের চাল ও আটা তৈরির। আর শীতের পিঠা তৈরি চলতো গ্রামের প্রায় সব বাড়ীতে। তবে কালের বিবর্তনে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে ঢেঁকিশিল্প। আর নতুন প্রজন্মের কাছে ঢেঁকি শব্দটি অতীতের গল্প মাত্র। তবে বাস্তবে এর দেখা মেলা ভার। এই গ্রাম বাংলায় আশির দশক পর্যন্ত ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছিল। এখন পার্টে গেছে সেই দৃশ্যপট। কথায় আছে “ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’ বাংলার এ প্রবাদ বাক্যটি বহুকাল ধওে প্রচলিত হলেও ঢেঁকি এখন আর ধান বানে না। গ্রামের জনপদগুলোতে এখন বিরাজ করছে শহুরে হাওয়া। তাই তো গ্রামে আর ঢেঁকি নেই, নেই ঢেঁকিশাল, নেই পল্লীবধুদের মন মাতানো গান। সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আর্বিভাব ঘটেছিল। আবার গতিময় সভ্যতার যাত্রায় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে ঢেঁকি বিলুপ্ত হচ্ছে । একে না মেনে নিয়ে উপায় নেই। দেশের গ্রামগুলোতে ঘুরলে ঢেঁকির দেখা মেলে না। আধুনিকতার ছোয়ায় ঢেঁকির জায়গায় দখল করে নিয়েছে বিদ্যুৎ চালিত মেশিন। গ্রামগঞ্জে গড়ে উঠেছে মিনি রাইস মিল। ফলে ঢেঁকির অস্তিত্ব আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। ঢেঁকিছাটা চাল ও চিড়া আজ আর নেই। এখন আর আগের মতো ঢেঁকিতে ধান ভানার দৃশ্য চোখে পড়ে না। ভোরের স্তব্ধতা ভেঙে শোনা যায় না ঢেঁকির ঢেঁকি ঢেঁকুর ঢেঁকুর শব্দ। চোখে পড়ে না বিয়েশাদি উৎসবে ঢেঁকি ছাটা চালের ক্ষীর পায়েস। অথচ একদিন ঢেঁকি ছাড়া গ্রাম কল্পনা করা কঠিন ছিল। এক সময়ে গ্রামের প্রায় সব সভ্রান্ত পরিবারেই ঢেঁকি ছিল। ধান ভাঙা কল আমদানির পর গ্রামাঞ্চল থেকে ঢেঁকির বিলুপ্তি শুরু হয়। ফলে গ্রামের মানুষ ভুলে গেছেন ঢেঁকিছাটা চালের স্বাদ। যান্ত্রিক সভ্যতা গ্রাস করেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকিশিল্পকে। বর্তমান যুগর অনেকেই ঢেঁকি চেনে না। কালের পাতায় স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে ঢেঁকি। যেখানে বসতি সেখানেই ঢেঁকি, কিন্তু আজ তা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে মুছে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে কিছু কিছু বাড়ীতে ঢেঁকি থাকলেও তা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার হয়। আগে তা হত না। ঢেঁকিশিল্প এখন রুপকথার গল্পের মতো। মহারাজপুর গ্রামের মনজিলা বেগম স্মৃতিচারণ করে বলেন, আগে সারাদিনই আমাদের বাড়ীতে ঢেঁকির কাজ চলত্ে ানিজের কাজের পাশাপাশি পাড়ার মানুষের কাজ করতে হতো। ঢেঁকিতে পাড় দিতে পায়ে ঠোস্কা পড়ে যেত। আমি যখন এই বাড়ীতে বউ হয়ে এসেছিলাম তখন দেখতাম আমার শাশুড়ি ঢেঁকি ব্যবহার করত। আমার শাশুড়ি চাউল তুলতেন আর আমি পাড় দিতাম ঢেঁকিতে। কতো লোকের কাজ হত। একবার চাউল তুলতে আমার শাশুড়ির হাতে ঢেঁকি পড়ে, তারপর সেই আঙ্গুল বাঁকা হয়ে যায়। আগে তো ঢেঁকিতে পাড় দিতে না জানলে মেয়েদের বিয়ে হত না। আমাদের সময় শাশুড়ি রাত থাকতে ডেকে তুলত, ঢেঁকিতে ধান ভানতে। এর এখন মেশিনে ভানা হয়। এখনকার মানুষ আর কষ্ট করতে চায় না। একই গ্রামের ভদি বেগম বলেন, এই নুনু আগে ঢেকির শব্দে বাড়িতে সবার কানে তালা লাগদ। ঢেঁকিতে ধান ভানা কষ্ট হলিও চাল বড্ড ভালো হুতু। আর ভাত খেতিও ভাল লাগদ। তবে ঢেঁকি এখন আর পাবা যায় না। সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ খায়রুল আলম বলেন, আধুনিক সভ্যতার ছোয়ায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের কিছু ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে।। এসব ঐতিহ্যের মধ্যে একটি হচ্ছে ঢেঁকি। একসময় এই অঞ্চলের প্রায়ই ঢেঁকি দেখা যেত, যা এখন আর দেখা যায়না। আধুনিক যন্ত্রের যুগে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহত গ্রামীণ ঐতিহ্যের ঢেঁকি কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু ঢেঁকি কেন ধীরে ধীরে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ী, ঘানি শিল্প, ধুপশিল্প, খয়েরশিল্প ও মৃৎশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে আমরা হয়ত ঢেঁকিসহ অন্য গ্রামীণ ঐতিহ্যের ব্যবহার করছি না, কিন্তু আমাদের উচিত গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের ধারক এই ঢেঁকিসহ সব ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা। অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য যাতে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে সেজন্য প্রচীন ঐতিহ্যের এসব উপকরণ সংরক্ষণ করা অতীব প্রয়োজন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তুহিন আলম বলেন, একসময় গ্রামবাংলার ঢেঁকিছাটা চাল ছিল। আধুনিক যন্ত্রের যুগে ঢেঁকি বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। তবে চিকিৎসা শাস্ত্র মতে আধুনিক মেশিনে ভানা চাল থেকে ঢেঁকিতে ছাটা চাল স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ঢেঁকি ছাট চালে পুষ্টিগুণ অটুট থাকে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com