এফএনএস লাইফস্টাইল: এমন একটা সময় ছিলো যখন শুধুমাত্র রোজার দিনেই বাজারে মিলতো খেজুর। তবে দিন বদলেছে, খেজুরের গুণ সম্পর্কে এখন অবগত সবাই। যে কারণে দেশের বাজারে বছরজুড়েই পাওয়া যায় মরুরর দেশের এই ফলটি। খেজুরে রয়েছে এমাইনো এসিড, প্রচুর শক্তি, শর্করা ভিটামিন ও মিনারেল। এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে। খেজুর শরীরের প্রয়োজনীয় গ্লুকোজের ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করে। খেজুরের গুণের কারণে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডায়েট ফুড’। এবার খেজুরের যাবতীয় পুষ্টিগুণ জেনে নেওয়া যাক- ১. ইন্সট্যান্ট এনার্জি : খেজুরকে বলা হয় ইন্সট্যান্ট এনার্জির ভাণ্ডার। মানে নিমিষেই প্রাণশক্তি। এটা শুধু প্রচলিত কথা নয়, রীতিমতো বিজ্ঞানীদের গবেষণা ফল। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ফুড সায়েন্সেস এণ্ড নিউট্রিশনের এক রিপোর্টে বলা হয়-কেউ যদি দুর্বল বা ক্লান্ত বোধ করে, তাহলে কয়েকটা খেজুর খেয়ে নেয়ার পর পরই দেখা গেছে আবারো সে চাঙ্গা, প্রাণশক্তিময় অনুভব করছে। বাসা-অফিস-রাস্তাঘাটে এখন প্রাণশক্তি ব্যয় হয় প্রচুর। দিন যত গড়াতে থাকে, ক্লান্তি-দুর্বলতা ততই যেন ঘিরে ধরতে থাকে দেহকে। খেজুর এ ক্ষেত্রে এক চমৎকার প্রতিরোধক হতে পারে। খেজুরে আছে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ ও সুক্রোজের মতো প্রাকৃতিক শর্করা যা এই ‘এনার্জি’র উৎস। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় আজ থেকে দুটো খেজুর রেখে দেখুন। দেখবেন সকালে যে প্রাণবন্ততা নিয়ে বেরিয়েছেন, সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরছেন, তখনও একইরকম প্রাণবন্ত অনুভব করবেন আপনি। ২. কোলেস্টেরল কমায়, ধমনীতে জমতে দেয় না চর্বির স্তর : মিষ্টি ফল হলেও খেজুরে কোনো ফ্যাট নেই, নেই কলেস্টেরল। বরং খেজুরে দেহের কলেস্টেরল কাটে। খেজুরের ‘ক্যাটাচিনস’ এন্টিঅক্সিডেন্টটি রক্তের ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল কমায়, বাড়ায় ‘ভালো’ কোলেস্টেরল। তাছাড়া খেজুর কোলেস্টেরলের অক্সিডেশন প্রক্রিয়াকে প্রতিরোধ করে যা রক্তনালীতে এথেরোসক্লেরোসিস ডিপোজিট হতে দেয়া না। সহজ ভাষায় ধমনীতে চর্বির স্তর জমতে দেয় না। অবশ্য খেজুরের এই উপকার ‘মেজুল’ প্রজাতির চেয়ে ‘হালাউয়ি’ প্রজাতির খেজুরে বেশি লক্ষণীয়। ৩. হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিস : এ তিনটি রোগকে বলা হয় এ শতাব্দির সবচেয়ে ঘাতক ব্যাধি। উল্লেখযোগ্য হলো- তিনটি রোগের বিরুদ্ধেই খেজুর লড়ে খুব সফলভাবে। যেমন, খেজুরে আছে এন্টিঅক্সিডেন্ট ফ্ল্যাভোনয়েডস। প্রদাহ সারাতে যা বেশ উপকারি। মিশরের সুয়েজ ক্যানেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে- খেজুরের ফ্ল্যাভোনয়েড ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে উপযোগী। ‘আইসোফ্ল্যাভন’ নামে একটি উপাদান আছে খেজুরে (ফলের মধ্যে এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। সেই সাথে ক্যারোটেনয়েডস নামে আরো একটি উপাদান আছে খেজুরে। হৃদরোগের ক্ষেত্রে এটাও কার্যকরী। আর খেজুরের ফেনোলিক অ্যাসিড নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। গবেষণায় দেখা গেছে- এবডোমিনাল ক্যান্সারের চিকিৎসা করা গেছে খেজুর দিয়ে কোনোরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই। ৪. রক্তচাপ কমায় : আমরা যেসব খাবার খাই তার অনেকগুলোতেই থাকে উচ্চমাত্রার লবণ। আর উচ্চ রক্তচাপের একটা বড় কারণই এটা। কিন্তু খেজুরে কোনো সোডিয়াম (লবণ) নেই। বরং আছে বেশ ভালো মাত্রার পটাশিয়াম (একটি খেজুরে প্রায় ১৬৭ মিগ্রা, যেকোনো ফলের তুলনায় যা বেশি) যা সোডিয়াম নিষ্কাশনে সাহায্য করে। এ কারণেই বলা হয়- খেজুর হচ্ছে এমন এক প্রাকৃতিক প্রতিষেধক যা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। তাছাড়া কিডনিতে পাথর জমারও একটা কারণ এই পটাশিয়ামের অভাব। ৫. হাড় মজবুত করে : একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বয়স যত বাড়ে আমাদের হাড় তত ক্ষয় হয়। সাথে ব্যথা এবং আনুষাঙ্গিক সমস্যা। খেজুরে আছে সেলেনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার এবং ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি খনিজ উপকরণ যা হাড়ের জন্যে উপকারি। ফলে অস্টিওপরেসিসসহ হাড়ের যে-কোনো রোগ প্রতিরোধের জন্যে এটি বেশ ভালো। ৬. দৃষ্টিশক্তি বাড়ায় : আপনি হয়তো বলবেন-আপনার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখুন তো, আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে আপনি এখন অনেক বেশি সময় মোবাইলের স্ক্রিনে কাটান কি না? বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে। অফিসে সূর্যের আলো ঢোকার জায়গা নেই বলে অনেক বেশি সময় ধরে আপনি কৃত্রিম আলোয় কাজ করছেন কি না? আর এসবকিছুরই ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে আপনার চোখে। খেজুর এটারই এক চমৎকার প্রতিষেধক। খেজুরে আছে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট ‘ক্যারোটানয়েডস’, দৃষ্টিশক্তির জন্যে যা উপকারি। এমনকি বয়স হয়ে গেলে চোখের পেশীর সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া সংক্রান্ত যে সমস্যা দেখা দেয়, খেজুর সেটাকেও প্রতিরোধ করে। ৭. মস্তিষ্ককে উজ্জীবিত করে : সকালটা যদি আপনি মাত্র দুটো খেজুর দিয়ে শুরু করতে পারেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন এ পার্থক্য। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে খেজুর। অস্ট্রেলিয়ায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে- খেজুর স্মৃতিশক্তি এবং শেখার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করেছে খেজুর। আসলে খেজুরে থাকা নানা ধরনের এন্টিঅক্সিডেন্টই এ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া বয়স হয়ে গেলে ব্রেনের যে ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়, খেজুর তার চমৎকার প্রতিরোধক। কারণ কর্টিসল এবং অক্সিডেন্ট নামে যেসব উপকরণের প্রভাবে এটা হয়, খেজুর তার প্রতিরোধ করে। ৮. পাইলস ও কোষ্ঠকাঠিন্য : পাইলস, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি রোগগুলো হয় সাধারণত খাদ্যে ফাইবার বা আঁশের অভাবে। আর খেজুরে যেহেতু প্রচুর আঁশ থাকে, তাই নিয়মিত খেজুর খেলে এ রোগগুলো আপনি সহজে প্রতিরোধ করতে পারবেন। ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার মেডিকেল সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে-দিনে মাত্র ২০-৩৫ গ্রাম খেজুর খেলেই তা যথেষ্ট মলকে নরম করার জন্যে, মলের খনি অনুপাতকে ঠিক রাখার জন্যে। যা কোষ্ঠকাঠিন্যকে প্রতিরোধ করে। ৯. ওজন কমায়, ওজন বাড়ায় : বলবেন, এ আবার কেমন ব্যাপার? একই খাবার একই সাথে কীভাবে ওজন বাড়ায় আবার ওজন কমায়! এটা কী করে সম্ভব! আসলে খেজুরে আছে ভিটামিন বি, ভিটামিন কে, রিবোফ্লোভিন, নিয়াসিন এবং আরো অনেক ধরনের পুষ্টি উপকরণ। এসবের মিলিত ফসল হলো মেটাবলিজম বাড়ানো। পরিণাম ওজন কমানো। এবং তা প্রাকৃতিকভাবে। কারণ কৃত্রিম বিভিন্ন উপায়ের কথা আমরা জানি যা সাময়িকভাবে ওজন কমালেও অচিরেই আবার তা ফিরে আসে। কিন্তু খেজুরের ক্ষেত্রে তা হয় না। কারণ হ্রাসকৃত ওজনে দেহকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে খেজুর সাহায্য করে। তাছাড়া খেজুর এমন একটি খাবার যা অল্প খেলেই তৃপ্তি হয়, ফলে বেশি খাওয়ার চাহিদা থাকে না। এবার ওজন বাড়ানো। হ্যাঁ, যদিও বেশিরভাগ মানুষেরই চিন্তা ওজন কমানো নিয়ে, কিছু মানুষ এমনও আছে যারা ওজন বাড়াতে চান। তাদের জন্যে খেজুর আদর্শ। ভেড়ার ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে- খেচুর বিচির ভূষি খেয়ে তাদের ওজন ৩০% পর্যন্ত বাড়ানো গেছে। অবশ্য মানুষের ক্ষেত্রেও এই গবেষণা প্রযোজ্য হবে কি না, তার জন্যে আরো গবেষণা দরকার। ১০. ত্বক সুন্দর করে : আকর্ষণীয়-কোমল ত্বক কে না চায়? কিন্তু এটা তো শুধু বাইরে থেকে মেকাপ করে হবে না। এর জন্যে দরকার খাবার। আর খেজুর এর চমৎকার সংযোজন। নিয়মিত খেজুর খেলে আপনার ত্বক হবে সতেজ, পরিচ্ছন্ন এবং প্রাণবন্ত! খেজুরে আছে প্রচুর ভিটামিন, এন্টি অক্সিডেন্ট। যেমন, ভিটামিন ‘সি’ ত্বকের নমনীয়তা বাড়ায়। ভিটামিন ‘ডি’ বাড়ায় কমনীয়তা। অধিকন্তু খেজুর দেহের মেলানিনের মাত্রা কমিয়ে বয়সের চিহ্নকে দূরীভূত করে। তৈলাক্ত ত্বককে সংরক্ষণ করতেও সহায়তা করে খেজুর। ত্বকের কোনো রোগ থাকলে সেটাকেও ভালো করে খেজুর। ১১. চুল পড়া বন্ধ করে : খেজুরে আছে আয়রন। যা রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ায়। আর চুলসহ গোটা শরীরেই তা ভারসাম্যপূর্ণভাবে পৌঁছায়। ফলে চুল পড়া যেমন কমে, তেমনি নতুন চুল গজায়ও। ১২. রক্তশূন্যতার সমস্যা : রক্তশূন্যতায় ভুগলে অবসাদ, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা- ইত্যাদি সমস্যাগুলো দেখা দেয়। রক্তশূন্যতার রোগীরাও খেজুর খেতে পারেন নিশ্চিন্তে। কারণ খেজুরে আছে প্রচুর আয়রন। তাছাড়া খেজুর রক্ত পরিষ্কারও করে। ১৩. গর্ভবতী মা এবং খেজুর : গর্ভবতী মায়েদের জন্যে দরকার বাড়তি ক্যালরি। আর খেজুরের চেয়ে উপকারী কিন্তু সমৃদ্ধ ক্যালরির উৎস খাবার কমই আছে। গর্ভাবস্থায় আরেকটি সমস্যা হয়, তা হলো- পাইলস। আর এর সমাধানই হলো আঁশজাতীয় খাবার খাওয়া যা প্রচুর পরিমাণে আছে খেজুরে। জর্ডানের একটি গবেষণায় দেখা গেছে- প্রসবের চার সপ্তাহ আগ পর্যন্ত যে মায়েরা পর্যাপ্ত খেজুর খেয়েছেন, প্রসবকালীন জটিলতা তাদের কম হয়েছে। সন্তানসম্ভবা মায়েদের জরায়ুর পেশী মজবুত করেছে খেজুর, সে প্রমাণও পাওয়া গেছে। ১৪. যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি : খেজুরে আছে এমন কিছু উপাদান যা পুরুষ এবং নারী- উভয়েরই যৌনশক্তি এবং যৌন ইচ্ছে বৃদ্ধি করে। এবং সেক্স হরমোন বৃদ্ধি পায়। ১৫. বাড়তি ভিটামিনের প্রয়োজন নেই : খেজুরে আছে ২৩টি অ্যামাইনো অ্যাসিড যার অনেকগুলো এমনকি আপেল, কমলা, কলার মতো স্বাস্থ্যকর হিসেবে জনপ্রিয় ফলেও নেই। আর হজমক্ষমতাকে বাড়াতে অ্যামাইনো এসিডেরই ভূমিকা মুখ্য। তাছাড়া অ্যামাইনো অ্যাসিড ‘কার্সিজেনিক’ নামে একটি টক্সিনকেও দেহের বাইরে বের করে দিতে সাহায্য করে। নিয়মিত খেজুর খেলে আপনার বাড়তি ভিটামিন খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই- বলছেন এখন বিজ্ঞানীরা। যেভাবে খাবেন : খেজুর এমন একটি খাবার যা আপনি সরাসরি যেমন খেতে পারেন, তেমনি উপকরণ হিসেবেও খাবারে ব্যবহার করতে পারেন। খেজুরকে কীভাবে চিনি-র বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, তা আগের পরিচ্ছদে বলা হয়েছে। হৃদরোগীরা খেজুর খেতে পারেন পানিতে ভিজিয়ে। রাতে দুটো খেজুর পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে ভেজানো পানিসহ খেজুর দুটো খেয়ে ফেলুন। তবে খেজুর যেহেতু একটি মিষ্টি ফল এবং এতে ক্যালরির পরিমাণ বেশি, তাই এটি পরিমিত খাওয়াই উত্তম। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলেন, দিনে দুটি খেজুরই যথেষ্ট খেজুরের এই উপকারগুলো পাওয়ার জন্যে।