এফএনএস : ইউক্রেনকে একটি চক্রব্যূহে আটকে ফেলেছে রাশিয়া। ছয় দিনের যুদ্ধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখলের পর রুশ সৈন্যদের প্রধান টার্গেট এখন রাজধানী কিয়েভ। দ্রুত শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চার দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। মঙ্গলবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত রাশিয়ার একটি বিশাল সাঁজোয়া বহর কিয়েভ থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। ওই বহরে পরমাণু অস্ত্রও থাকতে পারে বলে পশ্চিমাদের ধারণা। মঙ্গলবার খারকিভের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিতে রুশ বাহিনী প্রচন্ড আক্রমণ অব্যাহত রাখে। একই দিন ক্রেমলিন জানায়, ইউক্রেন দখল তাদের প্রধান লক্ষ্য নয়। পশ্চিমাদের কব্জা থেকে দেশটিকে রক্ষা করাই মূল লক্ষ্য। এ টার্গেট অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ইউক্রেনে অভিযান চলবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দারা মনে করছে, রাশিয়ার লক্ষ্য ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া। ইউক্রেনে রাশিয়ার অনুগত সরকার ক্ষমতায় বসানো এবং ইউক্রেনের বেশিরভাগ সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলা। খবর বিবিসি, ইন্টারফ্যাক্স, আলজাজিরা ও দ্য গার্ডিয়ান অনলাইনের। ইউক্রেনে হামলার ফলে রাশিয়ার ওপর কয়েক দফা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমারা। এ বিষয়ে মঙ্গলবার মস্কো সাফ বলে দিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কখনই রাশিয়াকে টলানো যাবে না। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, যেহেতু দুদেশের মধ্যে এখন মুখোমুখি আলোচনা শুরু হয়েছে তাই উভয় দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে আপাতত বৈঠকের সম্ভাবনা নেই। ইউক্রেনে সাধারণ জনগণকে লক্ষ্য করে গুচ্ছবোমা ও ভ্যাকুয়াম বোমা নিক্ষেপের অভিযোগকে ডাহা মিথ্যা বলে খারিজ করেন পেসকভ। গত সপ্তাহে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পশ্চিমারা রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংক ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাদের সম্পদ জব্দ করেছে। এদিকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য রাষ্ট্রগুলোসহ মোট ৩৬ দেশের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করেছে রাশিয়া। তবে ত্রাণসামগ্রীবাহী বিমান ও কূটনৈতিক মিশনের বিমানগুলোর ওপর এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না বলে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পাল্টা জবাব হিসেবে রাশিয়া এ ব্যবস্থা নেয়। এর আগে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহরের দখল নেয় রাশিয়া। যুদ্ধের পঞ্চম দিন সোমবার রাজধানী কিয়েভের আরও কাছাকাছি চলে আসে রুশ সৈন্যরা। অপরদিকে ইউক্রেন সেনাবাহিনী রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে প্রাণপণ লড়াই করছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির সাধারণ জনতা হাতুড়ি, ছুরি ও অন্যান্য ছোট অস্ত্র হাতে রুশ বাহিনীকে রুখতে রাস্তায় নেমেছেন। এসব দলে বহু নারীও আছেন। সোমবার কিয়েভের পাশাপাশি ইউক্রেনের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর খারকিভে ঢুকে পড়ে রুশ সৈন্যরা। এখানে ইউক্রেন বাহিনীর প্রবল বাধার মুখে পড়েছে রুশরা। রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়া ইউক্রেনের মারিয়াপোল, কাখোভকা, খেরশন ও বারদিয়ানস্ক থেকে হাজার হাজার লোক জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। মঙ্গলবারও হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘ অপেক্ষার পর সীমান্ত অতিক্রম করে। গত সপ্তাহে রুশ ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি যখন একের পর এক ইউক্রেনে ঢোকা শুরু করেছিল, তখন দেখা গিয়েছিল প্রতিটি সামরিক যানে সাদা রং দিয়ে ইংরেজী হরফের ‘জেড’ লেখা রয়েছে। যা নিয়ে রহস্য ক্রমে বাড়ছিল। সেই রহস্যের জট খুলতে না খুলতেই আরও একটি ছবি প্রকাশ্যে এলো। এবার ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেয়া রুশ ট্যাঙ্ক এবং হেলিকপ্টারে ঠিক একই রকম ভাবে সাদা রঙে ইংরেজী হরফে লেখা ‘ভি’। ‘জেড’ চিহ্নের ক্ষেত্রে সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, এগুলো বিশেষ সাঙ্কেতিক চিহ্ন। রুশ এবং ইউক্রেনীয় ট্যাঙ্ক এবং সাঁজোয়া গাড়িগুলো দেখতে অনেকটা একই রকম। হামলার সময় ‘সেমসাইড’ এড়াতে এমন চিহ্ন এঁকে দেয়া হয়েছে। আবার একাংশ দাবি করেছেন, কিভে পৌঁছনোর পূর্বনির্দিষ্ট পথের সঙ্কেত রয়েছে এতে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারী মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাক্সার টেকনোলজিস দাবি করেছে, কিয়েভের উত্তরে সেনা সমাবেশ ক্রমাগত বাড়াচ্ছে রাশিয়া। আন্তোনভ বিমানবন্দর এলাকার পূর্ব প্রান্তে শত শত সাঁজোয়া যান, ট্যাংক, কামান ও সরঞ্জাম বহনকারী যানের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। মাক্সার কেম্পানি আরও বলেছে, বেলারুশের দক্ষিণাঞ্চলে অতিরিক্ত স্থল সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। বোমা ফেলার কাজে ব্যবহৃত হেলিকপ্টার ইউনিটও মোতায়েন থাকতে দেখা গেছে সেখানে। ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ২০ মাইলেরও কম দূরত্বে বেলারুশের ওই এলাকার অবস্থান। মাক্সার কয়েক সপ্তাহ ধরেই স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করে ইউক্রেন সীমান্তের রুশ সেনা সমাবেশ শনাক্ত করার দাবি করে আসছে। তবে নিরপেক্ষভাবে ছবিগুলোর সত্যতা যাচাই করা যায়নি। ইউক্রেনের এক সেনাসূত্র বলেছে, ২৪ ঘণ্টায় রাশিয়া সেনা সমাবেশ বাড়িয়েছে। রাজধানী কিয়েভ ও অন্যান্য বড় শহর ঘিরে ফেলা হয়েছে। তারা কিয়েভসহ অন্যান্য বড় শহর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে। কিয়েভসহ বিভিন্ন শহরে হামলার সোমবার ইউক্রেন- বেলারুশ সীমান্তে আলোচনায় বসেছিলেন রাশিয়া ও ইউক্রেন। ইউক্রেন হামলা বন্ধের আহ্বান জানায়। কিন্তু এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। রুশ-ইউক্রেন রাষ্ট্রদূতকে তলব দিল−ীর : ইউক্রেনের খারকিভে রুশ বাহিনীর গোলায় ভারতীয় শিক্ষার্থী নবীন শেখারাপ্পার মৃত্যুর ঘটনায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অবিলম্বে খারকিভসহ বিভিন্ন শহরে আটকেপড়া ভারতীয়দের ইউক্রেনের বাইরে যাওয়ার জন্য ‘নিরাপদ পথ’ (সেফ প্যাসেজ) দেয়ার বার্তা দেয়া হয়েছে দুই পক্ষকে। দেশটির পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা পৃথকভাবে রুশ ও ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে এ বার্তা দেন। খারকিভ শহরে রুশ বাহিনীর বোমাবর্ষণে ভারতীয় শিক্ষার্থী নবীন শেখারাপ্পার মৃত্যুর পরই কূটনৈতিক কার্যক্রম চালায় নরেন্দ্র মোদি সরকার। মঙ্গলবার বিকেলে নয়াদিল−ীর রুশ ও ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এ বিষয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় ভারত। ইউক্রেন অভিযানে অংশ নিচ্ছে না বেলারুশ : ইউক্রেনে চলমান রুশ অভিযানে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিবেশী বেলারুশ অংশ নিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কো। মঙ্গলবার এক সাক্ষাতকারে এ তথ্য জানিয়েছেন তিনি। বেলারুশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে লুকাশেঙ্কো বলেন, ‘বেলারুশের সেনাবাহিনী ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে অংশ নিচ্ছে না এবং ভবিষ্যতে অংশ নেবে এমন কোন পরিকল্পনাও আপাতত সরকারের নেই। ‘তাছাড়া রাশিয়ার নেতৃত্বের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমাদের কোন কথা হয়নি। এখন পর্যন্ত তারা আমাদের কাছে সামরিক সহযোগিতাও চায়নি; আর আমরা মনে করছি, এই অভিযানে বেলারুশের অংশ নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কেউ আমাদের ধ্বংস করতে পারবে না : ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, কেউ আমাদের ধ্বংস করতে পারবে না। কারণ আমরা ইউক্রেনিয়ান। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে ভিডিও বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তাকে ইউরোপিয়ান নেতারা স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেয়। তিনি বলেন, তার দেশে যা ঘটছে তা খুবই দুঃখজনক এবং তারা স্বাধীনতা, জীবন ও দেশের জন্য লড়াই করছেন। জেলেনস্কি বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনের শিশুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে এবং সোমবারও ১৬ শিশু নিহত হয়েছে। এ সময় ইউক্রেনকে দূরে ঠেলে না দিয়ে নিজেদের ‘প্রকৃত ইউরোপিয়ান’ এবং ‘সবাই একসঙ্গে তাদের (ইউক্রেন) সঙ্গে আছেন তা প্রমাণের’ জন্য ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রতি আহ্বান জানান জেলেনস্কি। যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী : ইউক্রেনে রুশ হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে ইরান। একই সঙ্গে এই যুদ্ধের অবসান চেয়েছে দেশটি। মঙ্গলবার ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল−াহ আলি খামেনি এক টেলিভিশন ভাষণে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন সঙ্কটের মূল কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের নীতি। যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা সমস্যা সৃষ্টি করে ও সমস্যার মধ্যেই থাকে। সঙ্কট সৃষ্টি করেই তারা চলে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ‘আমার মতে তাদের এই নীতির ভুক্তভোগী ইউক্রেন। আজকের ইউক্রেন পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে এই পর্যায়ে টেনে এনেছে।’ ফরাসী মন্ত্রীকে মেদভেদেভের হুঁশিয়ারি : রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ পশ্চিমা কর্মকর্তাদের ভেবেচিন্তে কথা বলতে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধের ঘোষণা দেয়ার পর কড়া ভাষায় পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সমালোচনা করেন মেদভেদেভ।