এফএনএস এক্সক্লুসিভ: চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে মাদার ভ্যাসেলের (বড় আকারের জাহাজ) জট লেগেছে। লাইটারেজ জাহাজ সঙ্কটে পণ্য খালাস ব্যাহত হচ্ছে। ফলে দিনের পর দিন অনেক জাহাজকে অলস বসে থাকতে হচ্ছে। তাতে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের ডেমারেজ। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে প্রায় অর্ধশত মাদার ভ্যাসেল পণ্য খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। সমুদ্রপথে মাদার ভ্যাসেল বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্য নিয়ে প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে আসে। মাদার ভ্যাসেলের ড্রাফট বেশি হওয়ায় সেগুলো সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারে না। বরং তা থেকে বহির্নোঙ্গরেই লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করা হয়। তারপর সেসব পণ্য লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাটে ও বন্দরের জেটিতে এনে খালাস করা হয়। আবার লাইটারের জাহাজের মাধ্যমে নৌপথে পণ্য পরিবহণ করা হয় দেশের বিভিন্ন গন্তব্যেও। নৌপরিবহন অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রায় দেড় হাজার লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস ও পরিবহণ করা হয়। বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো—অর্ডিনেশন সেল লাইটারেজ জাহাজের সিংহভাগই নিয়ন্ত্রণ করে। ওই সংস্থাটিই প্রতিদিন বার্থিং সভা করে মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেয়। কিন্তুসংস্থাটি সম্প্রতি বহির্নোঙ্গরে মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে পর্যাপ্ত লাইটারেজ জাহাজের বরাদ্দ দিতে পারছে না। তাতে কার্যত অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাস। মূলত কিছু আমদানিকারক লাইটারেজ বা ছোট জাহাগুলোকে ভাসমান গুদাম হিসেবে ব্যবহার করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সূত্র জানায়, বর্তমানে সাগরে ও নদীতে বিপুলসংখ্যক লাইটারেজ জাহাজ ভোগ্যপণ্য ভাসছে। ওসব পণ্য রমজানকে সামনে রেখে আমদানি করা হয়েছে। এই মুহূর্তে ওসব পণ্য বাজারে গেলে দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কায় আমদানিকাররা ওই পণ্য খালাস না করে লাইারেজ জাহাজে রেখে দিয়েছে। আগে হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান রোজায় ভোগ্যপণ্য আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলেও এবার সরকারের নানা সুযোগ—সুবিধা বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে শুল্কছাড় দেয়ায় ছোট—মাঝারি অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করেছে। ফলে এবার চাহিদার চেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে। আর গত জানুয়ারিতে আগের বছরের জানুয়ারির তুলনায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৫১টি বেড়ে ৩৬৫টি হয়েছে। কিন্তু অনেক আমদানিকারকের নিজস্ব কোনো গুদাম না থাকায় ওসব পণ্য জাহাজেই রেখে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আমদানি পণ্য পাইপলাইনে এখনো এখনো অনেক পণ্য। সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষমাণ মাদার ভ্যাসেলগুলোতে রয়েছে গম, ডাল, সরিষা, লবণ, সয়াবিন ভূষি, রড, এইচ আর কয়েল, কয়লা, স্ল্যাগ, পাথর, বিভিন্ন ধরনের সারসহ আরো নানা আমদানি পণ্য। কিন্তু লাইটারেজ জাহাজের অভাবে মাদার ভ্যাসেলগুলো অপেক্ষমাণ থাকায় এর গড় অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিটি জাহাজের পরিচালন ব্যয় বাবদ দৈনিক ১৫ হাজার মার্কিন ডলার মাশুল দিতে হচ্ছে। যদিও এবার অতিরিক্ত পণ্য আমদানি হয়েছে। কিন্তু এমন অবস্থা চলতে থাকলে পণ্যের দামে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। জাহাজে পণ্য মজুদ রেখে যে ব্যয় হচ্ছে, তা ভোক্তার কাঁধেই চাপবে। এদিকে অতিসম্প্রতি লাইটারেজ জাহাজের বিদ্যমান সঙ্কট নিয়ে নৌপরিবহন অধিদফতরে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে জাহাজ মালিকদের সংগঠন, শিপিং এজেন্ট, চট্টগ্রাম বন্দরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক সঙ্কটের মূল কারণ হিসেবে লাইটারেজ জাহাজে পণ্যগুদাম হিসেবে রাখাকে দায়ী করেন। তিনি আমদানিকারকদের লাইটারেজ জাহাজগুলো খালি করে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ওই বৈঠকের পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় অধিদফতর ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে এ বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর মো. মকসুদ আলম জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে ৪৫টির বেশি মাদার ভ্যাসেল পণ্য নিয়ে অবস্থান করছে। পর্যাপ্ত লাইটারেজ জাহাজ না পাওয়ায় বহির্নোঙ্গরে মাদার ভ্যাসেলের জট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অনেক আমদানিকারক লাইটারেজ জাহাজকে গুদাম বানিয়ে ওসব পণ্য জাহাজে রেখেছেন। তারা ওসব পণ্য নিজস্ব গুদাম কিংবা গন্তব্যে নিয়ে খালাস না করায় জাহাজের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থা আমদানিপণ্য গুদামে না নিয়ে বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত করার মাধ্যমে কোনো সঙ্কট তৈরির অপচেষ্টা এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চক্রান্ত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ যারা আমদানি পণ্য জাহাজে গুদাম বানিয়ে রেখেছে তাদের গুদাম নেই। আর স্বাভাবিকভাবেই জাহাজ ভাড়া বাবদ খরচ ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করা হবে। ফলে আমদানি বেশি হলেও বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নৌ—পরিবহণ অধিদফতর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পণ্য খালাস না করে ভাসমান লাইটারেজ জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদফতরের অবস্থান কঠোর হবে।