এফএনএস : চাহিদার বেশি আমদানিতেও দেশের বাজারে চিনির দাম কমছে না। দেশের মানুষকে খুচরা পর্যায়ে প্রায় ৮২ টাকা কেজি দরে চিনি কিনতে হচ্ছে। দেশের চিনির চাহিদার প্রায় শতভাগই আমদানি করে মটানো হচ্ছে। আর সেটি করছে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। আন্তর্জাতিক দর, পরিবহন খরচ ওপর নির্ভর করে চিনির দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধকৃত মূল্যের অংকটিও বেশ চড়া। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সংকটের কারণে সৃষ্ট চাপ মোকাবেলায় বিভিন্ন পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও চিনির ক্ষেত্রে তা দৃশ্যমান নয়। বর্তমানে দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই দেশের সমুদ্র ও স্থলবন্দর দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে পৌনে ২৩ লাখ টনেরও বেশি চিনি আমদানি হয়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলেও বাজারে চিনির দাম বাড়ছে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) এবং দেশের চিনি খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এদেশে চিনির আমদানির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশের ৩টি বড় শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা, সিটি ও এস আলম গ্র“প চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে ৮৫ শতাংশেরও বেশি চিনি আমদানি করেছে। তাছাড়া ছোট পরিসরে দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড এবং আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারিও কিছু চিনি আমদানি করে। আমদানিকারক ওসব প্রতিষ্ঠান মূলত অপরিশোধিত চিনি দেশে এনে পরিশোধনের পর বাজারজাত করে থাকে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন খুবই নগণ্য হওয়ায় বর্তমানে ওই ৫ প্রতিষ্ঠানই দেশে চিনির চাহিদা পূরণ করছে। সূত্র জানায়, দেশে চিনি আমদানিতে শীর্ষে রয়েছে সিটি গ্র“প। প্রতিষ্ঠানটি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা মূল্যের ৭ লাখ ৭৬ হাজার টন চিনি আমদানি করেছে। মেঘনা গ্র“পের আমদানি করা ৭ লাখ ৬৩ হাজার টন চিনির দাম ২ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। এস আলম গ্র“প আমদানি করেছে ১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা মূল্যের ৩ লাখ ৮৯ হাজার টন চিনি। ছোট পরিসরে অবশিষ্ট চিনি আমদানি করেছে দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ৮৯৮ কোটি টাকা মূল্যের ২ লাখ ৪ হাজার টন ও আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ৪৪২ কোটি টাকা মূল্যের ১ লাখ ৪৬ হাজার টন চিনি আমদানি করেছে। বর্তমানে বাজারে চিনি বিক্রি প্রতি কেজি ৮০-৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক মাস আগেও চিনির কেজি ছিল ৭৮ টাকা। এক মাসে পণ্যটির দাম বেড়েছে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০০২ সালের আগ পর্যন্ত বিএসএফআইসি এককভাবে চিনি উৎপাদন ও আমদানি করতো। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার টন। পরের বছর (২০১৪-১৫ অর্থবছর) উৎপাদন নামে ৭৭ হাজার ৪৫০ টনে। তারপর ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন কিছুটা বেড়ে ৮২ হাজার ১৪০ টনে উন্নীত হলেও গত আখ মাড়াই মৌসুমে (২০২০-২১ অর্থবছর) ওই উৎপাদন কমতে কমতে ৪৮ হাজার ১৩৩ টনে এসে ঠেকে। ২০২০ সালে ৬টি চিনিকল বন্ধ হওয়ার পর স্থানীয় উৎপাদনে বড় ধাক্কা লাগে। চিনিকলগুলোর লোকসানের বোঝা কমাতে ওই সময় বিএসএফআইসি ওসব চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। চলতি অর্থবছর এখন পর্যন্ত দেশে ২৪ হাজার ৯০০ টন চিনি উৎপাদিত হয়েছে, যা সরকারি কলে উৎপাদনের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। বর্তমানে কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর (রংপুর), রংপুর ও সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) চিনিকল বন্ধ হওয়ায় ওসব এলাকায় আখের উৎপাদন একেবারেই কমে গেছে। আগামী নভেম্বরে তৃতীয় মাড়াই মৌসুম শুরু হবে। তবে স্থানীয় অনেক কৃষকই আখ চাষ বাদ দিয়ে অন্য ফসল আবাদ শুরু করেছে, যা চিনি শিল্পের জন্য অশনিসংকেত। এদিকে আপাতত চিনির বাজারের মূল্য স্থিতিশীল হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সর্বোচ্চ চিনি উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিলের চিনিকলগুলো চিনি রফতানির চুক্তি বাতিল করে আখ থেকে ইথানল উৎপাদন করে রফতানি করতে চুক্তিবদ্ধ হতে শুরু করেছে। বিশ্বজুড়ে সব ধরনের জ¦ালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় আখ থেকে উৎপাদিত বায়োফুয়েলের (জৈব জ¦ালানি) চাহিদা বেড়েছে। ফলে চিনির চেয়ে আখ থেকে ইথানল উৎপাদন অধিক লাভজনক হয়ে ওঠায় রফতানিকারক দেশ সেদিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। মূলত চিনির দামের পুরোটাই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে আমদানিকারকদের কিছু করার নেই। আমদানিকারকরা চাহিদার বেশি চিনি আমদানি করলেও তাদের বেশি দামেই চিনি কিনতে হচ্ছে। আর বাজারেও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হচ্ছে। চিনির দর বৃদ্ধির জন্য খাতসংশ্লিষ্টরা বিশ্ববাজারের পরিস্থিতিকেই দায়ি করছে। ব্রাজিল, চীন ও ভারত ওই তিন দেশ রফতানিকারক হিসেবে চিনি আমদানির বড় উৎস। গত জুলাই থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশে ৮ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকার ২২ লাখ ৭৮ হাজার টন চিনি আমদানি করা হয়েছে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করতে গিয়ে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। যার বোঝা ভোক্তাদের ওপর গিয়ে পড়ছে। যদি দেশের মূল চাহিদা স্থানীয় চিনিকলগুলোর মাধ্যমে অর্ধেকও পূরণ করা সম্ভব হতো, তাহলে ক্রেতাকে ওই বাড়তি দামের বোঝা বহন করতে হতো না। দেশে এখন বছরে ২০ লাখ টনের কাছাকাছি চিনির চাহিদা। আর দেশের রিফাইনারিগুলোর পরিশোধন ক্ষমতা বার্ষিক ৩০ লাখ টন। তাছাড়া সরকারিভাবেও কিছু পরিমাণে চিনি উৎপাদন করা হয়। সব মিলিয়ে বাজারে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি চিনির সরবরাহ হচ্ছে। এমন অবস্থায় অর্থনীতির চাহিদা-জোগানের সূত্র অনুযায়ী চিনির বাজার আরো স্থিতিশীল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারপরও পণ্যটির দাম বেড়ে চলেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বাণিজ্যিক পরিচালক (যুগ্ম-সচিব) মো. আনোয়ার হোসেন জানান, দেশে বর্তমানে বছরে ২০ লাখ টন চিনির সরবরাহ থাকলেই চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। চাহিদার এখন প্রায় পুরোটাই বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা করছে। তাদের পরিশোধন ক্ষমতাও চাহিদা অনুযায়ী বেশি।