## সচেতনতা বাড়াতে বজ্রপাত নিরোধে পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ ## মাঠে বজ্র নিরোধক টাওয়ার নির্মাণ পরামর্শ ## এপ্রিলে একদিনে মৃত্যু ৩২ জুনে ১৯
জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে \ জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এতে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ। কিন্তু নিষ্পাপ মানুষের প্রাণ রক্ষায় দৃশ্যমান পদক্ষেপ সরকার থেকে কম দেখা যায়। এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্প নেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। উদ্বেগ ঘাটতির কারণে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে। তথ্যমতে, বজ্রপাতের প্রতিকার হিসেবে ২০২১ সালে সরকার সারাদেশে ১০ লাখ তালগাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে তালগাছ নয়, ২৮ লাখ তালের আঁটি রোপন করেই দায় সেরেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের । এদিকে, বজ্রপাতে প্রাণহানীর ঘটনাকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ ও জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব এর মূল-কারণ। আগামীতে মৃত্যু এড়াতে জন-সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এ ছাড়া আরও ২টি কারণে বজ্রপাত বাড়ছে বলেও জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংশ্লিস্টরা। এর একটি জন-সংখ্যার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া এবং উঁচু গাছগুলো কেটে ফেলা। প্রাপ্ততথ্যমতে, নানা প্রতিকূলতায় বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। আন্তজার্তিক সংস্থা ‘রিস্কফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবিলিটি’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, প্রতিবছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়। বছরে দেড়শ’র মতো লোকের মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করলেও প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা পাঁচশ থেকে এক হাজার৷ বজ্রপাত সচেতনতায় কাজ করা সংগঠন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম (এসএসটিএএফ) বলছে, এই অবস্থা থেকে দ্রুত পরিত্রাণের জন্য পাঠ্য পুস্তকে বজ্রপাত সচেতনতা ও মাঠে বজ্র নিরোধক টাওয়ার নির্মাণ জরুরি। চলতি বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২৯ ও ৩০ এপ্রিল এই দুই দিনে বজ্রপাতে ৩২ জন নিহত হয়েছে। আর এসএসটিএএফ এর তথ্যমতে, বজ্রপাতে দেশের ১১ জেলায় গত শুক্রবার (১৭জুন) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৯ জন মারা গেছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহে ৬, সিরাজগঞ্জে ৩, রাজশাহীতে ২ জন মারা গেছেন। এছাড়া নওগাঁ, বগুড়া, জামালপুর, ঢাকা, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর ও দিনাজপুর জেলায় একজন করে মারা গেছেন। এ ছাড়া গত ১৯ জুন তিনজন মারা গেছেন। দুর্যোগ ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ২০৫, ২০১৬ সালে ২৪৫, ২০১৫ সালে ১৮৬, ২০১৪ সালে ২১০, ২০১৩ সালে ২৮৫, ২০১২ সালে ৩০১ এবং ২০১১ সালে ১৭৯ জন বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন৷ আর চলতি বছরের গত ১৭ জুন পর্যন্ত অর্ধ-শতকের বেশি মানুষের বজ্রপাতে প্রাণ গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উপ-পরিচালক) কাওসারা পারভীন বলেন, বজ্রপাত আগেও ছিল এখনো আছে। বছরের পুরো সময়জুড়ে যে পরিমাণ বজ্রপাত হয়; তার কয়েকগুন বেশি হয় বর্ষা মৌসুমে। বজ্রপাতে কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর একটি জন-সংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পাওয়া, মানুষের সচেতনতার অভাব, আর সারাদেশে যে পরিমাণ বড় ও উঁচু গাছ ছিল সেগুলোকে কেটে ফেলা বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ। একটি বজ্রমেঘ থেকে ৬০-৭০ হাজার বজ্রপাত হয়। মেঘের ঘর্ষণে কিছু উপরের দিকে উঠে যায় এবং কিছু মাটিতে নেমে আসে। নিেেচর গুলোকে উঁচু তালগাছ ও নারিকেল গাছ কিছুটা প্রতিরোধে সহায়ক হয়। বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ লাগানোর প্রকল্প প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই গবেষক বলেন, আদৌও তালগাছ লাগানো হয়েছে নাকি খেয়ে ফেলা হয়েছে তা আলাহই ভালো জানেন। বলেন, দেশের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে (আটটি স্থান) বজ্রমেঘগুলো প্রবেশ করে। আর কিছু মেঘ ঢোকে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে। বিশেষ করে হাওড়াঞ্চল (ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ) এগুলো নিচু এলাকা হওয়ায় সেখানে বজ্রমেঘ বেশি হয়। বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ঠেকানো যাবে না। এগুলো আসবে। তবে কিভাবে আমরা টিকে থাকতে পারি সেই ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, একদিনে মারা যাওয়া ১৯ জনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, – এদের মধ্যে ৮ জন শিশু-কিশোর এবং ৪ জন কৃষক। ফুটবল খেলতে গিয়ে তিন শিশু-কিশোর, ১ জন মাঠে গরু চড়াতে গিয়ে এবং মাছ ধরতে গিয়ে ২ জন মারা গেছে। ময়মনসিংহে একই পরিবারের ৩ শিশুসহ ৬ জন মারা গেছে। নিহতরা শিশুরা হলো- উপজেলার কংকরহাটি গ্রামের শহীদলাহর ছেলে সাঈদ মিয়া (১২), হাদিস মিয়ার ছেলে স্বাধীন মিয়া (১১), বিলাল হোসেনের ছেলে মো. শাওন (৮)। একই জেলার সদর উপজেলার দড়িকুষ্টিয়া বালাপাড়া গ্রামের কৃষক আবু বকর (৪০), জাহাঙ্গীর আলম (৩০)। নান্দাইল এবং ধোবাউড়া উপজেলার চরমুহিনী গ্রামের আবু সাঈদ (৩০)। এছাড়া, সিরাজগঞ্জে পৃথক দুটি বজ্রপাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর সিকিউরিটি গার্ডসহ তিন’জন মারা গেছেন। নিহতরা হলেন- উপজেলার সায়দাবাদ ইউনিয়নের সায়দাবাদ শিল্পপার্ক এলাকায় জাহাঙ্গীর আলম খানের ছেলে নাসির উদ্দিন (১৭) মারা যান। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যমুনার চরাঞ্চলের বর্ণি এলাকায় দরবেশ আলী মুন্সীর ছেলে আবদুর রাজ্জাক মুন্সী মারা যান। এছাড়া দূর্গা চরন (৫২) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএএফ) সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোলা বলেন, বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে হলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর এজন্য বজ্রপাত সচেতনতা বিষয়টি পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মাঠে মাঠে বজ্রনিরোধক টাওয়ার নির্মাণ করতে হবে। তিনি বলেন, মারা যাওয়া ১৯ জনের পরিসংখ্যান দেখলে বুঝা যায়, একই পরিবারের তিন শিশু ফুটবল খেলতে গিয়ে, এক শিশু মাছ ধরতে গিয়ে ও এক কিশোর মাঠে গরু চড়াতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যায়। আমাদের দেশে বৃষ্টি হলেই শিশু-কিশোর ফুটবল নিয়ে মাঠে খেলতে বের হয়। কিন্তু তারা ও তাদের পরিবার জানে না আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে ও বৃষ্টির সময় বজ্রপাত বেশি হয়। এজন্য সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। বজ্রপাতে ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক দশকে মোট মারা গেছে ২ হাজার ৭৮৫ জন। গত ১৭ জুন (শুক্রবার) বজ্রপাতে একদিনে মারা গেছে ১১ জন। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বছরের মে থেকে জুন পর্যন্ত এ সময়ে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। আর জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের প্রভাবে বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে। গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। ফলে বাড়তি আর্দ্রতা প্রভাব ফেলছে বর্ষা ঋতুর বৈচিত্রে। ফলে বাড়ছে বজ্রপাত, ঘটছে প্রাণহানি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনায় মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমশ বেড়েছে। বেশি মারা যায় মাঠে কাজ করা কৃষক। আর আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বজ্রপাতের কারণে বছরে গড়ে দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বজ্রপাত রোধে সারাদেশে গাছ রোপণ করতে হবে। গাছ বজ্রপাত থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখে। আর হাওড় অঞ্চলে যেহেতু বজ্রপাত বেশি হয় সেখানে প্রচুর ছাউনি নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া বজ্রপাত নিয়ে মানুষের মধ্যে আরও বেশি সচেতনতা দরকার বলে জানান তিনি। আর সংগঠনের ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার্স, বাংলাদেশ-এর রিসার্চ ফেলো ইঞ্জিনিয়ার মনির হুসাইন বলেন, আগেও বজ্রপাতে মানুষ মারা যেতো। কিন্তু আমরা জানতে পারতাম না। এখন প্রযুক্তির কারণে আমরা জানতে পারি। তিনি বলেন, বজ্রপাত থেকে মৃত্যু হার কমানোর জন্য সরকার কয়েকটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। খুব শিগগির প্রজেক্টগুলো নিয়ে কাজ শুরু হবে। বলেন, এপ্রিল, মে ও জুনে বজ্রপাতের তীব্রতা বেশি থাকে। ফলে এই সময় মানুষ যদি নিরাপদে অবস্থান না করে তাহলে বজ্রপাত শরীরে পরতেও পারে। এ সময়টাতে সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে চলাচলের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রনাথ বর্ন্মন বলেন, দুর্যোগ ও বজ্রপাতে প্রাণহানী এড়াতে গত মাসে আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এ বিষয়ে আমরা যাচাই-বাছাই করেছি। বাস্তবায়ন করবে দুর্যোগ অধিদপ্তর। এর আগে এটার উপরে একটা ফিজিাবিলিটি স্ট্যাডি করেছি। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ও আবহাওয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞরা সম্পৃক্ত ছিলেন। এই বিষয়ে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য শিঘ্রই পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হবে।