২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে গুম কমিশনসহ ১৫টি কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন পূর্ণ উদ্যমে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা সেটি বাস্তবায়নে প্রতিটি কমিশনই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের কথা একটু আলাদাভাবে বলতে চাই— কেননা এই দু’টি কমিশনের সুপারিশের ওপর প্রধানত নির্ভর করছে আমাদের আগামী নির্বাচন প্রস্তুতি ও তারিখ।
গতকাল মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি। দীর্ঘ ভাষণে সরকারপ্রধান নির্বাচন, সংস্কার কমিশন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন তিনি। বলেন, আমি প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদেরকে যদি, আবার বলছি “যদি”, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয় তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষদিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।
ড. ইউনূস বলেন, সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে গুম কমিশনসহ ১৫টি কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন পূর্ণ উদ্যমে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। গুম কমিশন গত পরশু তাদের প্রতিবেদনের প্রথম খণ্ড আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করে গেছেন। গুমের শিকার বহু পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে এটা এখন প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এই প্রতিবেদন পড়ার আগেই আপনাদেরকে সাবধান করে রাখি, এটা একটা লোমহর্ষক প্রতিবেদন। মানুষ মানুষের প্রতি কী পরিমাণ নৃশংস হতে পারে এতে আছে তার বিবরণ। অবিশ্বাস্য বর্ণনা। গত সরকারের ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে এই প্রতিবেদন অমর হয়ে থাকবে। আমি আশা করছি, কমিশনগুলো এখন থেকে নিয়মিতভাবে তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা পেশ করতে থাকবে।
তিনি বলেন, বড় খবর হলো প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়ে গেছে। কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এখন থেকে তাদের হাতে দায়িত্ব ন্যস্ত হলো ভবিষ্যৎ সরকার গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করার। তারা তাদের প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছেন। বড় কাজ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। এটা এমনিতেই কঠিন কাজ। এখন কাজটা আরও কঠিন হলো এজন্য যে গত তিনটা নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না। ভোটার তালিকা যাচাই করার সুযোগ হয়নি কারোর। গত ১৫ বছরে যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য হয়েছে তাদের সবার নাম ভোটার তালিকায় তোলা নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র—জনতার অভ্যুত্থানের পর এখানে গলদ রাখার কোনো সুযোগ নেই। আমার একান্ত ইচ্ছা এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের তরুণ—তরুণী ভোটারেরা শতকরা ১০০ ভাগের কাছাকাছি সংখ্যায় ভোট দিয়ে একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি করুক। নির্বাচন কমিশন এবং সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের প্রতি আমার আহ্বান সবাই মিলে আমরা যেন এই লক্ষ্য অর্জনে নানা প্রকার সৃজনশীল কর্মসূচি গ্রহণ করি। তিনি বলেন, এখন থেকে সবাই মিলে এমন একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে পারি যে, স্থানীয় নির্বাচনসহ সকল নির্বাচনে সকল কেন্দ্রে প্রথমবারের ভোটাররা ১০০ শতাংশের এর কাছাকাছি সংখ্যায় ভোটদান নিশ্চিত করবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার সাহস করতে পারবে না। এবার আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদেরকে ভোট দেয়া নিশ্চিত করতে চাই। সবকিছুই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর সঙ্গে যদি আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও উন্নত করতে চাই, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করতে চাই, তাহলে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিস্তৃতি ও গভীরতা অনুসারে নির্বাচন কমিশনকে সময় দিতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ লক্ষ শহীদকে স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অগণিত শিশু—কিশোর, তরুণ—তরুণী, যুবক—যুবতী, বৃদ্ধ—জনতার আত্মত্যাগের ফলে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু আমরা সেই অর্জনকে আমাদের দোষে সম্পূর্ণতা দিতে পারিনি। সর্বশেষ এবং প্রচণ্ডতম আঘাত হানলো এক স্বৈরাচারী সরকার। সে প্রতিজ্ঞা করেই বসেছিল এদেশের মঙ্গল হতে পারে এমন কিছুই সে অবশিষ্ট থাকতে দেবে না। তিনি বলেন, এ বছরের বিজয় দিবস বিশেষ কারণে মহাআনন্দের দিন। মাত্র চার মাস আগে একটি অসম্ভব সম্ভব হয়ে গেল, দেশের সবাই মিলে একজোটে হুংকার দিয়ে উঠলো, পৃথিবীর ঘৃণ্যতম স্বৈরাচারী শাসককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করেছে ছাত্র—জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থান। নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিতের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, একটি বৈষম্যহীন দেশ গড়ার তাগিদে ছাত্র—জনতা স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রক্ত দিয়ে চার মাস আগে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য যে ঐক্য গড়ে তুলেছিল, সে ঐক্য এখনো পাথরের মতো মজবুত আছে। মাত্র কয়েক দিন আগে জাতি আবার গর্জে উঠে সমগ্র পৃথিবীকে সে কথা জানিয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, পরাজিত শক্তি তাদের পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তারা প্রতিদিন দেশের ভেতরে এবং বাইরে থেকে জনতার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করার জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে নানা ভঙ্গিতে তাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাচার করা হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের আয়ত্তে রয়েছে। তাদের সুবিধাভোগীরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আমাদের ঐক্য অটুট থাকলে তারা আমাদেরকে আমাদের লক্ষ্য অর্জন থেকে ব্যর্থ করতে পারবে না। সজাগ থাকুন। নিজের লক্ষ্যকে জাতির লক্ষ্যের সঙ্গে একীভূত করুন। পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদেরকে আমাদের লক্ষ্য অর্জন থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। আমি দেশের গণমাধ্যমকর্মী ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানাই, বিশ্বের কাছে দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরুন। অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সত্যই হোক আমাদের হাতিয়ার।
ড. ইউনূস বলেন, জাতির এই নিরেট ঐক্য এই বছরের বিজয় দিবসকে স্মরণীয় করে রাখবে। ইতিহাসের অনন্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে রাখবে। এই ঐতিহাসিক অর্জনের জন্য দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল তরুণ—তরুণী, যুবক—যুবতী, বৃদ্ধ—বৃদ্ধা সবাইকে আমার অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই ঐক্যের জোরে আমরা আমাদের সকল সমস্যার দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করতে পারবো।
এ সময় গণঅভ্যুত্থানকে অভিনন্দন জানাতে ও বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস—হোর্তাবেকে স্বাগত জানান ড. ইউনূস। বলেন, তিনি তার দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ২০০২ সালে পূর্ব তিমুর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কয়েকদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯ জন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রায় সকল দেশের রাষ্ট্রদূত একসঙ্গে ঢাকায় এসে সরকারের সঙ্গে বৈঠক করলেন। এই দেশগুলোর বেশির ভাগ দূতাবাস দিল্লিতে। তারা অনেকেই আগে কোনোদিন ঢাকায় আসেনওনি। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। একত্রে ঢাকায় আসলেন শুধু এই বার্তা দেয়ার জন্য যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়ার জন্য প্রস্তুত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগ এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রক্রিয়ার কথা আমি তাদেরকে জানিয়েছি। সেটিতে তারা পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ভুল তথ্য প্রচারের বিষয়েও আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের জানিয়েছি। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে যাদের ভিসা অফিস নয়াদিল্লিতে আছে, তাদেরকে ঢাকা বা অন্য কোনো প্রতিবেশী দেশে ভিসা অফিস নিয়ে আসার জন্য আমি অনুরোধ করেছি। তারা যদি ভিসা সেন্টার ঢাকায় নিয়ে আসেন তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভোগান্তি কমে যাবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতার মাত্রা বাড়ানোর বিষয়ে আমি আলাপ করেছি। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সকল দাতা প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সক্ষম হয়েছে। তারা নতুন উদ্যোগে এবং নতুন উৎসাহে আমাদের সঙ্গে নতুন আর্থিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে এগিয়ে এসেছে। অর্থনীতির সাফল্যের ব্যাপারে দেশে এবং বিদেশে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে অর্থনীতি তখন ভেঙে পড়ার অবস্থায়। গত চার মাসে এই অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা এবং নিয়ম—শৃঙ্খলা ফিরে আসছে। কোনো ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হয়নি। ব্যাংক যতই দুর্বলই হোক তাকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারের শুরুতেই শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির কাজ ছিল অভ্যুত্থানের পর অর্থনীতি কোন পরিস্থিতিতে যাত্রা শুরু করলো তার একটা দলিল রচনা করা। ড. দেবপ্রিয়ের সভাপতিত্বে গঠিত ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি নির্ধারিত সময়ে এই কঠিন কাজ সম্পন্ন করে আমাদের কাছে ৪০০ পৃষ্ঠার একটা বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেছে। রিপোর্ট পড়ে দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদী সরকার দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দিয়ে গেছে এটা সবাই বুঝতে পারছিল। বিশাল বিশাল প্রকল্প নেয়া হয়েছে ঋণের টাকায়। এসব প্রকল্পের মোড়কে বিশাল বিশাল অর্থ লুটপাট করেছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে যে, বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক টাকাই লুটপাট হয়েছে। দেশে এমন ধরনের পোষ্যতোষী পুঁজিবাদ তৈরি করা হয়েছিল যার সুবিধাভোগী ছিল স্বৈরাচার ও তার সহযোগীরা। তাদের পাচার করা এই টাকা আপনাদেরই। তারা প্রকাশ্যে আপনাদের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করে বিদেশে ভোগবিলাসে ব্যয় করেছে। প্রতিবছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হার দেখানো হয়েছে সেটাও মনগড়া। দেশকে এবং পৃথিবীকে বলা হচ্ছিল কী সুন্দর দেশ বাংলাদেশ— লাফিয়ে লাফিয়ে তার উন্নয়ন এগিয়ে চলছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কাজ হলো পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা। তারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সেটা চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন আয়োজন ও সংস্কার ছাড়াও আপনারা আমাদের ওপর অনেকগুলো দায়িত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছ থেকে আমরা বিপর্যস্ত এক অর্থনীতি পেয়েছি। আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৪.১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের মাসের তুলনায় ১৫.৬৩ শতাংশ বেশি। সামগ্রিকভাবে, ২০২৪ সালের জুলাই—নভেম্বর সময়কালে রপ্তানি ১৬.১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি আয় ছিল ১৪.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বছরের হিসেবে এই প্রান্তিকে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ১২.৩৪ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এসবের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
সরকারপ্রধান বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিক ভাই—বোনেরা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তাদের বার্ষিক মজুরি ৯ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনা করে শ্রমিক ইউনিয়ন, মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এটি নির্ধারণ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আমরা এখনো পাইনি। তবে আমার বিশ্বাস, মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমে আসবে। গত কয়েক মাসে বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আমরা সরবরাহ বাড়িয়ে, আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে, মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে এবং বাজার তদারকির মধ্যদিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এখনো পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। এটা সম্ভব হলে আমরা আশা করি জিনিসপত্রের দাম আরও কমে আসবে। আমরা আপনাদের কষ্টে সমব্যথী। তবে আমরা জানি সরকারের কাজ কেবল সমবেদনা জানানো নয়। আমরা আপনাদের কষ্ট কমিয়ে আনতে সকল রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে আমরা সবার সহযোগিতা চাই। আমরা ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের কাছে ওয়াদা করেছে বাজারে পণ্য সরবরাহের কোনো সংকট হবে না। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে যদি কেউ কৃত্রিম কোনো সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করে আমরা তাকে কঠোর হাতে দমন করবো। বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে বিকল্প কৃষি বাজার চালু করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত পতিত স্বৈরশাসক ও তার দোসরদের বিচার কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। এজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আসামিদের বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সব ধরনের সুযোগ তারা পাবেন। বিচার প্রক্রিয়া সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বিচারের যেকোনো অংশ চাইলে যে কেউ রেকর্ড করার সুযোগ পাবেন।
তিনি বলেন, আইসিসি প্রসিকিউটর করিম খান সমপ্রতি আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি আইসিসি প্রসিকিউটর এবং অন্যান্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে সম্মত হয়েছেন এবং আইসিটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আলাদাভাবে আমরা গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করবো বলে তাকে জানিয়েছি।
ড. ইউনূস বলেন, জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের ছাত্র—শ্রমিক—জনতা মিলে যে অসাধ্য সাধন করেছে তার অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকায় ছিল এ দেশের নারীরা। ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রাণঘাতী অস্ত্রের সামনে হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়েছিল আমাদের মেয়েরা। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী— সকল পেশার, সকল বয়সের নারীরা এ আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। এ বছর বেগম রোকেয়া দিবসে দেশ জুড়ে আন্দোলনে নারীদের আত্মত্যাগ ও ভূমিকার বিষয়ে বড় আকারে আলোচনা হয়েছে। ঐদিন জুলাই কন্যারাও ঘোষণা দিয়েছে তারা তাদের কথা কাউকে ভুলে যেতে দেবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারী অধিকার রক্ষায় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন করেছে। শিগগিরই তারা তাদের রিপোর্ট দেবে। যে তরুণীরা জুলাই আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকলো, তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় থেকে আর কোনো দিন সরে যাবে না। তারা শুধু নতুন বাংলাদেশ নয় নতুন এক পৃথিবী গড়ে তোলার মহাকর্মযজ্ঞে বাংলাদেশের সকল বয়সের নারীদের সঙ্গে নিয়ে নেতৃত্ব দেবে।
বিজয়ের মাসে দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, শক্তিশালী স্বৈরাচারী সরকারকে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমেই আমরা হটাতে পেরেছি। তারা এখনো সর্বশক্তি দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সামপ্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যকে নস্যাৎ করতে চাচ্ছে, একের প্রতি অন্যের বিষ উগড়ে দিতে চাচ্ছে। তাদের এই হীন প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই সফল হতে দেবেন না। তিনি বলেন, এটা আমাদের বিজয়ের মাস। ১৬ই ডিসেম্বরে যুদ্ধ জয় করে পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতির একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাস। শত্রুকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার মাস। নিজের শক্তিকে আবিষ্কার করার মাস। এই বিজয়ের মাসে আমরা সকল প্রস্তুতি নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যাত্রা শুরু করলাম। এই যাত্রা শুভ হোক। গন্তব্যে পৌঁছানো নিশ্চিত ও আনন্দদায়ক হোক। বিজয়ের মাস হোক নারী—পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে জাতির মহা ঐক্যের মাস। বিজয়ের মাস হোক ছাত্র—জনতার অভ্যুত্থানকে স্মরণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার শপথ দৃঢ়তার সঙ্গে পুনর্ব্যক্ত করার মাস। বিজয়ের মাস হোক নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তরুণদের প্রচণ্ড দুঃসাহস প্রকাশের মাস।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ হচ্ছে সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ার লক্ষ্যে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠন করবে সরকার। যে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর সহ—সভাপতি হিসেবে থাকবেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ। গতকাল মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে এমনটাই জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দীর্ঘ ভাষণে নির্বাচন, সংস্কার কমিশন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন তিনি। বলেন, যেকোনো সংস্কারের কাজে হাত দিতে গেলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন। এই ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া কী হবে? সরকার প্রথম পর্যায়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এরা শিগগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করবে বলে আমি আশা করি। আমরা এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এর কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সকল পক্ষের সঙ্গে মতামত বিনিময় করে যে সমস্ত বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে সেগুলো চিহ্নিত করা এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা। সরকারপ্রধান বলেন, যেহেতু জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তা বিবেচনা করে আমি এই কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবো। আমার সঙ্গে এই কমিশনের সহ—সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন প্রফেসর আলী রীয়াজ। কমিশন প্রয়োজন মনে করলে নতুন সদস্য কো—অপ্ট করতে পারবে। প্রথম এই ছয়টি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আগামী মাসেই জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন কাজ শুরু করতে পারবে বলে আমি আশা করছি। তিনি বলেন, এই নতুন কমিশনের প্রথম কাজ হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে সমস্ত সিদ্ধান্ত জরুরি, সে সমস্ত বিষয়ে তাড়াতাড়ি ঐকমত্য সৃষ্টি করা এবং সকলের সঙ্গে আলোচনা করে কোন সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায় সেই ব্যাপারে পরামর্শ চূড়ান্ত করা।