জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে \ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০ বছর (সুর্বণ-জয়ন্তি) পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল শুক্রবার। দিনটি ছুটির দিন হলেও বিশেষ অধিবেশন উপলক্ষ্যে তা কর্ম-দিবস হিসেবে গণ্য করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংসদ সচিবালয়। এর আগে স্বাধীন বাংলাদেশে সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। সেই অর্থে বলা যায়, অভিষেক এবং সংসদের সুবর্ণজয়ন্তি (প্রথম এবং একাদশ তম) দুটি জাতীয় সংসদ ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে। প্রথম সংসদের স্পিকার ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাহ আবদুল হামিদ (১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল-১ মে ১৯৭২)। এ সংসদে আরও দু’জন দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারা হলেন মোহাম্মদউল্লাহ; তিনি রাষ্ট্রপতি হলে সংসদের সভাপতির আসনে বসেন আবদুল মালেক উকিল। প্রথম সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন তৎকালিন ক্ষমতাসীন দলের মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ। একই ভাবে সুবর্ণ জয়ন্তির এই সন্ধিক্ষণে স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মনোনীত স্পিকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী দক্ষতার সঙ্গে করছেন সংসদ পরিচালনা। সুবর্ণ জয়ন্তির শুভক্ষণে সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু। অন্য কারণে এই বিশেষ অধিবেশটি তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করছে। কারণ প্রথম সংসদের নেতা ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান। আর একাদশ জাতীয় সংসদের সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদের রেকর্ডের তথ্যমতে, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৭জন ব্যক্তি সংসদ পরিচালনায় স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একই ব্যক্তি একাধিক বার স্পিকার হয়ে অলংকৃত করেছেন সংসদকে। পুরুষের পাশাপাশি নারীও আছেন এ তালিকায়। এরা হলেন, – জাতীয় পার্টির শামসুল হুদা (৩য় ও ৪র্থ সংসদ), বিএনপির শেখ রাজ্জাক আলী (দু’বার-৫ম ও ৬ষ্ঠ সংসদ), আওয়ামী লীগের এডভোকেট আবদুল হামিদ (সপ্তম ও নবম সংসদ) এবং আওয়ামী লীগের ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী (নবম, দশম ও একাদশ সংসদ -চলমান)। এর বাইরে বিএনপির মির্জা গোলাম হাফিজ, আবদুর রহমান বিশ্বাস, আওয়ামী লীগের হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও শওকত আলী (ভারপ্রাপ্ত)। তবে, টানা তিন মেয়াদে স্পিকার হয়ে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন একাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীন দেশে সংসদের ৫০ বছরে বিশেষ অধিবেশনের সংখ্যা এখন পর্যন্ত একটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সাড়ম্বরে উদযাপনে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা উপলক্ষ্যে প্রথম বিশেষ অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের ৯ নভেম্বর। এবার সংসদের সুবর্ন জয়ন্তি উপলক্ষ্যে দ্বিতীয় বিশেষ অধিবেশনটি শুরু হতে যাচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় এটা শুরু হবে। দেশে স্বাধীনতার পর ৩০০ আসনে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। আর সংরক্ষিত নারী আসন ছিল ১৫টি, যা বর্তমানে ৫০টি। আন্দোলনের নানা পটভ‚মিতে ৭১ এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। এরপর শুরু হয় দেশ গঠনের কাজ। শুরুতেই গণপরিষদের মাধ্যমে রচিত হয় স্বাধীন দেশের সংবিধান। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। এর আগে ছিল গণপরিষদ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯ জন এবং পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ৩০০ জনসহ মোট ৪৬৯ জন সদস্যের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল। এ ছাড়া প্রথম নির্বাচনে ২৯৩ আসন পায় আওয়ামী লীগ। বাকি সাতটির মধ্যে পাঁচটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জেতে। জাসদ একটি এবং বাংলাদেশ জাতীয় লীগ আরেকটি আসতে জিতেছিল। ওই সংসদে কোনো বিরোধীদলীয় নেতা ছিল না। প্রথম সংসদের প্রথম বৈঠকের দিন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের পর তাদের অভিনন্দন জানাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমরা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি, সে ইতিহাসে যেন খুঁত না থাকে। দুনিয়ার পার্লামেন্টারি কনভেনশনে যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো আমরা মেনে চলতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে যেন এমন একটি পার্লামেন্টারি প্রসিডিওর ফলো করতে পারি, যাতে দুনিয়া আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। “এখানে কোনো দল বা মতের নয়- এখানে এই দেখব যে, প্রত্যেক সদস্য যেন যার যে অধিকার আছে, সে অধিকার ব্যবহার করতে পারেন। সেদিকে আপনিও (স্পিকার) খেয়াল রাখবেন বলে আমি আশা পোষণ করি। এ সম্পর্কে আপনি আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। ‘পার্লামেন্টারি ট্রাডিশন’ পুরোপুরিভাবে ফলো করতে আমরা চেষ্টা করব।” সংসদ নিয়ে নিজের আবেগ প্রকাশ করে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রস্তাব পাস হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আজ আপনারা ‘কন্সটিটিউশন’ সংশোধন করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছেন। আমার তো ক্ষমতা কম ছিল না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমস্ত ক্ষমতা আপনারা দিয়েছিলেন। “আমার দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি দরকার, তা আমার আছে। মাত্র ৭ জন ছাড়া সমস্ত সদস্যই আমার। তবু আপনারা ‘এমেন্ডমেন্ট’ করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছেন। এই সিটে আমি আর বসব না- এটা কম দুঃখ না আমার। আপনাদের সঙ্গে এই হাউসের মধ্যে থাকব না-এটা কম দুঃখ নয় আমার। এদিকে, সংসদের সুবর্ণজয়ন্তি উদযাপন উপলক্ষ্যে বিশেষ অধিবেশন ঘিরে সংসদ এলাকায় বিরাজ করছে সাজ সাজ রব। জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের জাতীয় জীবনে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসেও ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল একটি ঐতিহাসিক দিন। কারণ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয় এ দিন। সংসদের সুবর্ণ জয়ন্তি (৫০ বছর) উপলক্ষ্যে বিশেষ অধিবেশনের মাধ্যমে এদিনটি উদযাপন করতে যাচ্ছে। ফলে চলতি বছরটিই আমাদের জাতীয় সংসদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ তাৎপর্যও বহন করবে। স্পিকার বলেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন। এটা মহান নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। তিনি ১১ জানুয়ারি গণপরিষদ গঠন করে তাদের উপরে রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ৪টা নভেম্বর রচিয়ত সংবিধান গণপরিষদে পাস করা হয়। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এটি কার্যকর হয়। এ সংবিধানই আমাদের সর্বোচ্চ আইন। এর আলোকে রাষ্ট্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচা বিভাগ এর সকল কার্যক্রম সংবিধানেই বর্ণিত আছে। এর আলোকে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ গঠিত। তিনি বলেন, আমাদের সংসদটি এককক্ষ বিশিষ্ট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন বৃটেন ও ভারত দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট; যথাক্রমে হাউস অফ কমান্স ও হাউস অফ লর্ডস এবং লোকসভা ও রাজ্যসভা। বাংলাদেশে ৩০০ সংসদীয় আসন থেকে জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। পাশাপাশি ৫০টি সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদের পঞ্চাশ বছরের এই শুভক্ষণে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে বর্তমান একাদশতম সংসদের জানিয়ে স্পিকার বলেন, বর্তমান সংসদের সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন নারী, বিরোধী দলীয় নেতা রওশান এরশাদ, সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী এবং স্পিকার-ও নারী ( ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী)। বিশেষ এই দিবস উদযাপনের জন্য কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছি জানিয়ে স্পিকার বলেন, এর একটি বিশেষ অধিবেশন হবে; ইতিমধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তা আহবান করেছেন। আগামীকাল (আজ ৬ এপ্রিল) থেকে এর কার্যক্রম শুরু হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ৭ এপ্রিল সংসদে আসবেন এবং সেখানে স্মারক বক্তব্য দেবেন। বলেন, যদিও দিনটি শুক্রবার তবুও আমরা কার্যদিবস হিসেবে গণ্য করে নেয়া হবে। পরবর্তী অংশে বিধি ১৪৭ এ কার্য-প্রণালী বিধির আলোকে সেটা আমরা তৈরি করব, লিখব এবং সেই প্রস্তাবটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা সেটা সংসদে উত্থাপন করে তার পক্ষে বক্তব্য রাখবেন। তার বক্তব্যের পর সকল সদস্যরা আলোচনায় অংশ নেবেন। বিশেষ করে যারা প্রবীণ সদস্য আছেন যারা ১৯৭৩ এর সংসদে ছিলেন তারাই মূল বক্তব্য রাখবেন। ৮ এপ্রিল দিনব্যাপী এই আলোচনা চলবে এবং ৯ এপ্রিল সংসদ সমাপ্ত হতে পারে। সেটা ৬ এপ্রিল সংসদীয় কার্যউপদেষ্টা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হবে।