এফএনএস : বর্তমান যুগ হচ্ছে ডিজিটের যুগ। অত্যাধুনিক ডিভাইসের যুগ। মানুষ এখন আর সেই আগের মতো খোলা আকাশের নীচে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে না, এখন ঘরের ভেতর ডিভাইসবন্দি হয়ে থাকতেই তাঁদের পছন্দ। এই ডিভাইস আসক্তিতে শুধু নবীন-প্রবীণরাই আক্রান্ত নয়, চরমভাবে আক্রান্ত শিশু-কিশোররাও, যা দিনদিন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিছুদিন আগেও শিশুদের হাতে প্রযুক্তিগত ডিভাইসগুলোর ব্যবহার নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে কোনো দু:শ্চিন্তা ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে শিশুদের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব ভাবিয়ে তুলেছে মা-বাবাদের। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার গবেষণায় স¤প্রতি দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ৬০ লাখ শিশু কিশোর ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তির কারণে নানা জটিলতায় ভুগছে। সন্তানদের এই ডিজিটাল আসক্তিকে নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরাও। তাদের মতে, রাতে ঘুমের সময়, খাবার সময়, হাটাচলার সময় বাচ্চাদের মোবাইল লাগে। মোবাইল ছাড়া দিন চলে না তাদের। এতে ওদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। মনের বিকাশটা ওরা এখন মোবাইলের সঙ্গে করে থাকে। বাবা-মার সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। প্রযুক্তি সেবার বাজারে আলোড়ন তুলেছিলেন ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ তথ্য ফাঁসকারী সাবেক কর্মী ফ্রান্সিস হাউগেন। হাউগেনের ফাঁস করা নথিপত্র থেকে উঠে আসে কিশোর বয়সীদের ওপর ইনস্টাগ্রামের বিরূপ প্রভাবের বিষয়ে জানা থাকলেও মুনাফার লোভে বিষয়টি চেপে গেছে ফেসবুক। পরবর্তী সময়ে সিনেট শুনানিতে হাজির হয়ে হাউগেন সাক্ষ্য দেন, করোনাভাইরাস এবং এর টিকা সম্পর্কে বিপজ্জনক ভুয়া তথ্য প্রচারের সুযোগ দিচ্ছে সোস্যাল জায়ান্টটি। ফেসবুকের ব্যবসায়িক কর্মকান্ড আর মেনে নিতে না পেরে গত বছর প্রতিষ্ঠানটির চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন ফ্রান্সিস হাউগেন। তবে চাকরি ছাড়ার আগে কপি করে নিয়েছিলেন ফেসবুকের বেশকিছু অভ্যন্তরীণ নথিপত্র। অবশ্য ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে অন্যভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাঁরা এর অপকারের চেয়ে উপকারের দিকটার কথা তুলে ধরে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুক তখন দাবি তোলে, ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাদের গবেষণার ফলাফল। গুরুত্ব পায়নি ইনস্টাগ্রামের ইতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি। এর কয়েক দিন বাদে সিনেটে সাক্ষ্য দেয়ার সময়েও একই বক্তব্য দিয়েছেন ফেসবুকের নিরাপত্তাবিষয়ক বৈশ্বিক প্রধান অ্যান্টিগন ডেভিস।ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ও ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নতুন নীতিমালা তৈরি করবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি)। নীতিমালা না মানলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে সোস্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে। এতে কোন দ্বিমত নেই যে, মানুষের জীবনের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো শৈশব। এই সময়টাতে মানুষের বিকাশ হয় সবচেয়ে দ্রুত। জীবনের মূল্যবান এই সময়টাকে গ্রাস করে ফেলছে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। ফলে শিশুরা একদিকে যেমন বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে, নানা শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৫-১৭ বছর বয়সী স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৮ শতাংশই কোনো না কোনো মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় মাসের মধ্যেই মানুষের মস্তিষ্কের অর্ধেকের গঠন সম্পন্ন হয়ে যায়। আট বছরের মধ্যে বিকাশ হয় মস্তিষ্কের ৯০ শতাংশ। বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ, সামাজিক যোগাযোগÑমস্তিষ্কের বিকাশে ভ‚মিকা রাখা এসব বিষয় শিশুর শারীরিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের অভিজ্ঞতাগুলো শিশুর ভবিষ্যতের প্রভাবক হিসেবে ভ‚মিকা রাখে। এসব নিয়েই বিকশিত হয় মস্তিষ্ক। বিকশিত হওয়ার পথে বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে শিশুদের নির্ভরতার অনেকটাই অভিভাবক ও শিক্ষকের ওপর। কিন্তু শিশুরা এখন আর অভিভাবকের কথা শুনছে কথায়। তাঁদের নিত্যসঙ্গী এখন ইলেকট্রনিক ডিভাইস। এ ছাড়া দারিদ্র্য, পুষ্টিজ্ঞানহীনতার কারণেও শিশুদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জানা যায়, শারীরিক ও মানসিক জটিলতা বা ফাংশনাল ডিফিকাল্টিসের ক্ষেত্রে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের অবস্থা বেশি শোচনীয়। প্রতিটি জটিলতার সঙ্গে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কযুক্ত। ভুক্তভোগীদের ১০ শতাংশ অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান আর অতিধনী পরিবারের সন্তান ৬ শতাংশ। বিভাগভিত্তিক অবস্থানে বরিশাল ও ময়মনসিংহের শিশু-কিশোররা শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এসব শিশু-কিশোরের ২১ শতাংশ বরিশাল ও ১৮ শতাংশ ময়মনসিংহের বাসিন্দা। মূলত মানসিক স্বাস্থ্যের বিরূপ প্রভাব রয়েছে স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে। বিষণœতায় ভুগছে ৪ শতাংশ ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতার হার ৩ শতাংশ। ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে আচরণ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা রয়েছে যথাক্রমে ৩ ও ২ শতাংশ। এ ছাড়া দৃষ্টি ও শ্রবণ সমস্যা, বন্ধু তৈরিতে অনীহা, যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারা, মনোযোগ ভঙ্গ হওয়া, চলাফেরায় সমস্যা, নিজের প্রতি যতœ নেয়ার অক্ষমতা, শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের বিষয়ে অভ্যস্ত হতে না পারা, শিখন সমস্যা ও মনে রাখতে না পারার মতো শারীরিক ও মানসিক জটিলতা রয়েছে। শৈশবে শিশুদেরকে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে উৎসাহ প্রদান করলে তাঁদের মানসিক বিকাশ দ্রুত সাধিত হয় বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। কথা বলা, পড়া, গান গাওয়া, ধাঁধার সমাধান ও অন্যান্যের সঙ্গে খেলাধুলা শিশুর ওপর সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলে। দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশু মনোযোগ দিয়ে শোনে, কথায় সাড়া দেয়, শব্দের অনুকরণ করে, প্রথম অর্থবোধক শব্দ বলে, বড়দের কাজ-কর্ম অনুকরণ করে, বন্ধুত্ব গড়ে তোলে, সমস্যার সমাধান করে ও খেলাধুলা শুরু করে। তিন থেকে পাঁচ বছরে শিশুরা নতুন নতুন বিষয় শেখা উপভোগ করে, দ্রুত ভাষা রপ্ত করতে থাকে, কোনো বিষয়ে বেশি সময় মনোযোগ ধরে রাখার সক্ষমতা অর্জন করে ও নিজের মতো করে কিছু করতে চায়। কিন্তু বর্তমানে তাঁদের এই বিকাশের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইলেকট্রিক ডিভাইস। একটু বুঝতে শিখলেই শিশুরা হাতে নিয়ে নিচ্ছে মোবাইল। পিতা-মাতারাও, ক্ষতির দিকটা বিবেচনা না করে সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন সেই ভয়ানক যন্ত্র। ক্রমে ক্রমে এই ডিভাইস তাদের ঘাড়ে চেপে বসছে দুষ্ট ভ‚তের মতো। তারা হয়ে পড়ছে চরম আসক্ত। এই আসক্তি তাদের অন্যান্য কার্যক্রম থেকেও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আর এসব কারণে বাচ্চাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধছে। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইস এড়িয়ে চলতে হলে শিশুদের পড়াশোনা পাশাপাশি বিভিন্ন শারীরিক অনুশীলন এবং ইনডোর ও আউটডোর খেলায় মনযোগী করে তুলতে হবে বলে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।