এফএনএস : উচ্চ আদালত ডেথ রেফারেন্স মামলার চাপ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ নিম্ন আদালতে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়ার পর ডেথ রেফারেন্সের মামলার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কারাগারগুলোর কনডেম সেলে ফাঁসির আসামির সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতি বছরই বাড়ছে ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা। বর্তমানে দেশের কারাগারগুলোতে ২ হাজারেরও বেশি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বন্দী রয়েছে। পাশাপাশি ৯ হাজারেরও বেশি ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। কবে ওসব ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি হবে তার প্রতীক্ষায় কনডেম সেলের বন্দী ও তাদের স্বজনরা দিন গুনছে। এমন পরিস্থিতিতে ডেথ রেফারেন্স মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি ১১টি বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন। আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ডেথ রেফারেন্স মামলার নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গঠিত ১১টি বেঞ্চের কারণে মামলার জট কমে আসবে বলে আদালত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ইতোমধ্যে নবগঠিত বেঞ্চগুলোতে ৫২টি মামলার তালিকা দেয়া হয়েছে। আদালত সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের মতে, বেঞ্চ বাড়ানোর পাশাপাশি পেপারবুক তৈরিতেও জোর দেয়া প্রয়োজন। হাইকোর্টের রুলস অনুযায়ী পেপারবুক তৈরি করবে বিজি প্রেস। কিন্তু বিজি প্রেসে অন্যান্য কাজ করে পেপারবুক তৈরি করে থাকে। ওই কারণে ডেথ রেফারেন্স মামলার পেপারবুক তৈরি করতে অনেক সময় লেগে যায়। মামলার দীর্ঘসূত্রুার এটি একটি অন্যতম কারণ। ইতোমধ্যে যে সমস্ত মামলার পেপারবুক প্রস্তুত আছে সেগুলো শেষ হয়ে গেলে বেঞ্চ থাকলেও মামলা হবে না। সেজন্য পেপারবুক তৈরিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। কারণ একজন ফাঁসির আসামিকে হাইকোর্টে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। আর হাইকোর্ট যদি কোন আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন তাহলে মামলার চ‚ড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত আসামিকে ১৫ থেকে ২০ বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক আসামি খালাস পেয়ে থাকে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসময়ের কারণে আসামিও ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছে। সূত্র জানায়, ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালত যখন আসামিদের মৃত্যুদন্ড দেন তখন ওই দন্ড কার্যকরের জন্য হাইকোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। সেজন্য সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা মোতাবেক মামলার সব নথি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেয়। যা ডেথ রেফারেন্স নামে পরিচিত। ওই নথি আসার পর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে। পেপারবুক তৈরি হলে মামলাটি হাইকোর্টে শুনানির জন্য তৈরি মর্মে ধরে নেয়া হয়। পেপারবুক প্রস্তুত হওয়ার পর ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিরা যদি আপীল করে থাকে তা শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ডাদেশ ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক সাজা কার্যকর করার আইনগত কোন বিধান নেই। মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করতে কয়েকটি আবশ্যক আইনগত ধাপ অতিক্রম করতে হয়। প্রথমত, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারামতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন নিতে হবে। একইসঙ্গে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১০ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়েরের বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়ত, হাইকোর্ট বিভাগ মৃত্যুদন্ড বহাল রাখলে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সাংবিধানিক অধিকার বলে আপীল বিভাগে সরাসরি আপীল দায়ের করতে পারে। তৃতীয়ত, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৫ অনুযায়ী আপীলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের আইনগত সুযোগ রয়েছে। সর্বোপরি, মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৯ এর অধীন রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারে। রাষ্ট্রপতি ওই ক্ষমার আবেদন নামঞ্জুর করলে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আইনগত বৈধতা লাভ করে। কিন্তু বাংলাদেশে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ড ঘোষণার পরই সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্জন কনডেম সেলে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামি হিসেবে বন্দী রাখা হয়। দেশের কারাগারগুলোতে বর্তমানে ২ হাজারেরও বেশি ফাঁসির আসামি কনডেম সেলে বন্দী আছে। সূত্র আরো জানায়, প্রধান বিচারপতি নিম্ন আদালতের মৃত্যুদন্ড অনুমোদন ও আসামিদের আপীল নিষ্পত্তির জন্য ১১টি বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন। সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটিসহ কোর্টের অবকাশে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ডেথ রেফারেন্স এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য মামলাসমূহ নিষ্পত্তির জন্য ওই বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। ২০ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ওসব বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য মামলার বিচার কাজ পরিচালিত হবে। গঠন করা সবগুলো বেঞ্চই দ্বৈত। তার আগে প্রধান বিচারপতি ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানিতে দীর্ঘসূত্রতায় মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের কনডেম সেলে থাকার কষ্ট অনুভব করেন বলে জানিয়েছেন। বর্তমানে ১১টি বেঞ্চের ৫২টি মামলা রয়েছে। ২০ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটিসহ কোর্টের অবকাশকালীন সময়ে ওসব বেঞ্চে ৫২টি ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ওসব বেঞ্চ গ্রহণযোগ্য মামলার সন ও নম্বরের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মৃত্যুদন্ডাদেশ কনফারমেশনের রেফারেন্স এবং একই রায় হতে উদ্ভূত সকল ফৌজদারি আপীল ও জেল আপীল এবং ওই রায় হতে উদ্ভূত ফৌজদারি আপীল ও জেল আপীল মঞ্জুরির আবেদনপত্র এবং ফৌজদারি বিবিধ যদি থাকে এবং উপরোলিখিত বিষয়াদি সংক্রান্ত রুল ও আবেদনপত্র গ্রহণ ও শুনানি করবেন। এদিকে উচ্চ আদালতের সিনিয়র আইনজীবীদের মতে, মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিরা কনডেম সেলে দীর্ঘদিন থাকছে। যা অমানবিক। ডেথ রেফারেন্স শুনানির দীর্ঘসূত্রতার এক নম্বর কারণ পেপারবুক তৈরি। হাইকোর্টের রুলসে বলা আছে পেপারবুক তৈরি করবে বিজি প্রেস। কিন্তু বিজি প্রেস অন্যান্য কাজ করে তা করে থাকে। ফলে পেপারবুক তৈরিতে দেরি হয়ে থাকে। সেজন্য হাইকোর্টের অধীনে একটি প্রেস করার কথা আইনজীবীরা বলেছেন। যেখানে হাইকোর্টের কাজ হবে। পেপারবুক তৈরি হবে। তাতে কাজটি দ্রুত করা যাবে। পাশাপাশি আদালত বেঞ্চ বেশি দিলেও শুনানির দ্রুত হবে। কনডেম সেলে আসামিদের অনেকেই খালাস পেতে পারে। কিন্তু ওসব আসামি যে এতোদিন কনডেম সেলে ছিল তার জবাব কে দেবে। পেপার বুক তৈরি করতে আলাদা প্রেসের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা চেয়ে ২০১৬ সালে একটি রিট করা হয়েছিল। সেই রিটের প্রেক্ষিতে রুলও দিয়েছে হাইকোর্ট। এখন চ‚ড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। বিগত ২০০৮, ২০১০ সালের ডেথ রেফারেন্স মামলার পেপারবুক এখনও তৈরি হয়নি। তবে কোন কোন মামলার দ্রুত পেপারবুক তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক জানান, বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগে শুনানি করতে বেশ সময় লাগে। এ সমস্ত মামলার শুনানি দ্রুতত হওয়া উচিত। বিচারিক আদালতের মৃত্যুদন্ডের সাজা বাস্তবায়ন করতে হলে উচ্চ আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন। ওই অনুমোদন কতোদিনে জানানো হবে বা জানতে হবে তা আইনের কোথাও নির্দিষ্ট করে বলা নেই। তা বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে দীর্ঘ সময় লাগলেও আসামি কিংবা বাদীপক্ষ কেউ কোন আপত্তি তুলতে পারছে না।